পাবলো ও ঘোড়া।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ

ঘোড়া

জানালা থেকে আমি ঘোড়াদের দেখছিলাম।

এক শীতে আমি বার্লিনে। আলো ছিলো আলোহীন, আকাশে ছিলো না আকাশ।

বায়ু ছিল সাদা টাটকা রুটির মতো।

আমার জানালা থেকে আমি এক ধরণের সার্কাস-বলয় দেখছিলাম,
শীতের দাঁতে কাটা তুষারদষ্ট একটি বলয়।

আকস্মিকভাবে, একজন মানুষ তাড়িত হয়ে
দশটি ঘোড়া সপ্রতিবাদ ছুটে গেল তুষারের ভেতর।

তারা প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো
আগুনের মতো, কিন্তু তারা আমার দৃশ্যজগতকে ভরিয়ে তুললো,
যা আগে ছিলো শূন্য। সর্বাঙ্গ সুন্দর, অগ্নিশিখাসদৃশ
তারা ছিলো দশজন দেবতার মতো বিশাল, পরিচ্ছন ক্ষুরসহ
তাদের কেশর ছিলো সফেন-লবণাক্ত স্বপ্নের মতো।

তাদের পশ্চাদ্দেশসমূহ ছিলো পৃথিবীর অথবা কমলালেবুর মতো সুগোল।

মধু, তৃণমণি এবং আগুন ছিল তাদের রঙ।

তাদের গ্রীবা ছিল গর্বোদ্ধত পাথর-খোদাই করা
সু-উচ্চ চূড়োর মত।
এবং শক্তি, কারাবন্দির মতো, ক্রোধোন্মত্ত তাদের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিলো।

এবং নিঃশব্দে, মধ্যদিনে
এক নোংরা, বিরক্তিকর শীতে
ঐ শক্তিমত্ত ঘোড়াগুলো হয়ে ওঠলো রক্ত,
ছন্দ, হয়ে ওঠলো জীবনের প্রাণবন্ত ঐশ্বর্য।

আমি তাদের দিকে তাকালাম, দেখলাম এবং নব
শক্তিতে চাঙ্গা হয়ে ওঠলাম।
আমি এটি জানতাম না কিন্তু এটিই ছিল উৎসমূল,
সোনালী নৃত্য, আকাশ, আগুন যা জীবনে লাফিয়ে ওঠে তাবৎ সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে।

আমি বার্লিনের সেই বিষণ্ণ শীত ভুলে গেছি।

আমি কখোনই এই ঘোড়াগুলো হতে উৎসারিত আলোর কথা ভুলবো না।
মূল: পাবলো নেরুদা।

অনুবাদ: মুজিব রাহমান

পাবলো নেরুদা:

(জন্ম: জুলাই ১২,১৯০৪,মৃত্যু: সেপ্টেম্বর ২৩, ১৯৭৩)

খুব ছোটবেলা থেকেই কাব্যসিন্ধুর ডুবুরি ছিলেন নেরুদা। চিলির দক্ষিণের এই কবি কাব্যিক অনুপ্ররণা লাভ করেছিলেন কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কাছ থেকে। উল্লেখ্য, ছোট শহর টেমুকোর বিদ্যালয়ে পড়াকালিন নেরুদার শিক্ষক ছিলেন মিস্ত্রাল। ১৯৪৫ সালে চিলির প্রথম সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবির দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছিলেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। তিনিই পাবলো নেরুদাকে জীবনের শুরুতে কবিতায় প্রাণিত করেছিলেন। পনের বছর বয়সেই নেরুদার কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে। তাঁর বয়স যখন কুড়ির কোঠার প্রথম ভাগে তখনই তিনি চিলির জনপ্রিয় কবিদের একজন হয়ে ওঠেছিলেন।

লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে ওঠেছিল বিধায় তিনি একজন কূটনীতিকের কাজ নিয়ে এশিয়া এবং ইউরোপের অনেক দেশে একাদিক্রমে অনেক বছর নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু প্রথম দিকে সাম্মানিক কন্সাল পদে অনেকটা অবৈতনিক কাজই তিনি করেছেন। এবং প্রকট আর্থিক দৈন্য তাঁকে ভীষণভাবে নিষ্পেষিত করেছিল। দেশে দেশে তাঁর ভ্রমণ তাঁকে সুযোগ করে দিয়েছিল মানুষ এবং বিবিধ সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে অধ্যয়নের। শেষের দিকে নেরুদার সাথে দেখা হয়েছিলো স্পেনের বিখ্যাত কবি ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার। লোরকা নেরুদার ভূয়সীপ্রশংসা করেন। মেক্সিকোতে কন্সাল থাকাকালিন ১৯৪৩ সালে তিনি দেশটির প্রাচীন সভ্যতা আগাগোড়া জেনে নিয়েছিলেন। এক সময়ের বিলুপ্ত নগর পেরুর মাচু পিচু তথা ইনকা সভ্যতার নিদর্শনসমূহ তিনি পরিদর্শন করেছিলেন। এবং রচনা করেছিলেন তাঁর প্রায়শ বিবেচিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ১২ সর্গে রচিত দাসত্ব, মৃত্যু এবং পুনরুত্থান বিষয়ক মহাকাব্যিক কবিতা

The Heights of Machu Picchu।
আন্দ্রে স্পিয়ার্স অনূদিত মাচু পিচু কবিতাটির শেষের কয়েক চরণ পড়া যাক:

Give me the silence, the water, the hope.

Give me the struggle, the iron, the volcanoes.

Hang your bodies on me like magnets.

Rush to my veins and to my mouth.

Speak through my words and in my blood.

স্পেনের গৃহযুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে অঙ্গীকৃত করে তুলেছিল বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। চিলিতে ফিরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টিতে। এবং নির্বাচনে জিতে সেনেটের হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। শেষমেশ অবশ্য আলেন্দের পক্ষে কবি তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে তাঁর কড়া-কট্টর সমালোচনা তাঁকে প্রেসিডেন্টের ক্রোধের শিকারে পরিণত করেছিলো। এবং তাঁকে বেশ ক বছর বিদেশে কাটাতে হয়েছিল।
সাহিত্যে চিলিয় দ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর। স্পেনিশ ভাষী লেখকদের মাঝে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ নোবেল বিজয়ী আর ল্যাটিন অ্যামেরিকানদের মাঝে ছিলেন তৃতীয়।

অর্ধ শতাব্দের সৃষ্টিশীল জীবনে তাঁর পঞ্চাশটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। নানান আঙ্গিকে তিনি লিখেছেন। ঘন সংহত ভাব সমৃদ্ধ নিরীক্ষামূলক কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনি লিখেছেন সরল এবং সরাসরি বক্তব্যধর্মী কবিতা। ল্যাটিন অ্যামেরিকার ইতিহাসের পুনর্ব্যাখ্যামূলক মহাকাব্যিক কবিতা যেমন লিখেছেন তেমনি প্রতিদিনকার পণ্যসামগ্রী পেঁয়াজ, কাঁচিও হয়ে ওঠেছিল তাঁর কবিতার উপজীব্য। চিলির ভূ-দৃশ্যপট আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছিল তাঁর কবিতার নাভিকেন্দ্র। অনেক সমালোচকই নেরুদাকে ল্যাটিন অ্যামেরিকার বিশ শতকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করেন।

এক অসামান্য অভ্রান্ত আঙ্গিকে নেরুদা তাঁর Memoirs ভরে তুলেছেন তাঁর সমসাময়িক সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও জগৎ চিত্রণে।
কবি, শিল্পী এবং নেতাদের মাঝে যাঁরা তাঁর বন্ধু ছিলেন তাঁরা হলেন যথাক্রমে লোরকা, এলুয়া, পিকাশো এবং রিভেরা, গান্ধী, মাও সে তুং, সালভাদর আলেন্দে এবং চে গুয়েভারা।
বন্ধু কবি লোরকা হত্যাকাণ্ডের পর নেরুদা কমিউনিস্ট হলেন এবং দেশ ও মানুষের জন্য কবিতা লিখে হলেন জনতার কবি। দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এই সেনেটর কবি। ১৯৪৯ সালে ঘোড়ায় চড়ে আন্দিজ অতিক্রম করে চিলি থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন রেলওয়ে শ্রমিক পুত্র বিপ্লবী ও কবি পাবলো নেরুদা।
মূলত, নেরুদা ছিলেন পরস্পর-স্বতন্ত্রভাবে একজন কবি, শরণার্থী, রাষ্ট্রদূত ও রাজনীতিক। এবং তাঁর জীবন একই প্রগাঢ়ত্ব প্রতিফলিত করে যা করে তাঁর কবিতা। তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক Memoirs গ্রন্থে কবিতা এবং শান্তিকে একান্ত একাত্ম করে দেখেছেন যেমন একান্ত একাত্ম ময়দা এবং রুটির অস্তিত্ব। তাঁর কথায় –

Peace goes into the making of a poem as flour goes into the making of bread.’

তাঁর একটি তাৎপর্যবহ কথা দিয়ে এ ভূমিকা শেষ করা যেতে পারে :

“If you ask what my poetry is, I must confess that I don’t know; but if you ask my poetry, it will tell you who I am.”

এভাবে কবি ও কবিতাকে একান্ত একাত্ম করে, অবিভাজ্য করে ময়দা আর রুটির রূপকে যে কবি নিজেকে উপস্থাপন করেন তিনিই পাবলো নেরুদা, প্রিয় কবি নেরুদা।

মুজিব রাহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন