বানর রাজা চীনা পুরাণ (উপন্যাসিকা)
চীনের এক সুপার হিরোর গল্প (দ্যা জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট থেকে)
অ্যারন শেপার্ড অনুবাদ পান্থজন জাহাঙ্গীর

সপ্তম পর্ব।। বুদ্ধের বাজী

সিন্দুর প্রাসাদের আলকেমি ল্যাবরেটরিতে আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু প্রভু ডাউ টিজু অষ্ট ধাতু গলানোর পাত্রের ডাকনা খুললেন। তারপর ধপ করে বানরটিকে ফেললেন। এরপর মেঝের যে পাশে উনুন আছে,পাত্রটিকে সেখানে তুললেন।
‘‘তুমি যত পারো আগুন জ্বালাও’’, তিনি তার সহকারিকে বললেন। আমাদের যতদূর সম্ভব এই ভিলেন কে পরিশোধিত করার জন্য সর্বোচ্চ তাপ দরকার ।
এরমধ্যেই বানর উঠে আসার জন্য ছুটাছুটি শুরু করে দিল। বানর বলল, আমাকে তাপ দিচ্ছেন কেন? বানর অবাক হয়ে দেখল আর মাথা দিয়ে ধাতু পাত্রে আঘাত করতে থাকল, কোন স্বর্গে আমাকে নিয়ে এসেছেন?
সে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ালো, এটাতো এক প্রকার চিনামাটির পাত্র এবং এটা তো উত্তপ্ত হচ্ছে! আপনারা কি আমাকে বেকারির বিস্কুট বানাতে চাচ্ছেন? নাকি ছাই করে ফেলবেন? ঠিক আছে আমি তা হতে দিব না। বানর জোরে ধাক্কা দিল এবং জোরে লাথি দিয়ে ডাকনা খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলনা । তারপর বানর তার কান থেকে সেই ক্ষুদ্র কর্মীকে নিল। এটি হাতে নিয়ে বলল বলল, বড়ো হও!
এক ঝলকানিতেই কর্মী পাঁচ ফুট বেড়ে গেল। পাত্রের নিচের দিক থেকে ধাক্কা দিয়ে ডাকনা খুলল। যেইমাত্র বানর লাফ দিয়ে বের হয়ে আসলো সাথে সাথে মহান ধর্মগুরুর দরোজায় পায়ের গোড়ালি দিয়ে কষাঘাত করে মাথা ঢুকিয়ে ধর্মগুরু কে অবাক করে দিলেন। সোনালী দরোজার মেঘ প্রাসাদ থেকে সিন্দুর প্রাসাদের সব পথের স্বর্গের প্রত্যেক কর্মচারির দিকে বানর তার সেই ধাতুর অস্ত্র উচিয়ে মহা ক্ষিপ্ততার সাথে দৌঁড়তে লাগলো। বানর স্বর্গের এক জায়গায় স্বর্গের মহা অলৌকিক শক্তির জেনারেল এবং বারোজন বজ্র জেনারেলকে দেখতে পেল । যারা সবাই তার এই দৃশ্য দেখে ফেকাশে হয়ে গেলেন।
বানর চিৎকার করে বলল, আপনারা ভেবেছেন, বানর রাজা থেকে পালাতে পারবেন! ঠিক আছে এখানে জাদি বাদশাহর জন্য একটা সংবাদ আছে,আমি এখন আর অশ্ব রক্ষক নেই। আমিই এখন স্বর্গের সমান মহাসাধু এবং জাদি বাদশাহর দিন শেষ। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করছি তিনি যদি সিংহাসন থেকে না নামেন আমি আসব এবং টেনে নামিয়ে দিব। স্বর্গের জেনারেলের কাছ থেকে যে সংবাদটি শুনেছিলেন স্বর্গীয় শুভ্র হলে জাদি বাদশাহ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তাকে সিংহাসন ছেড়ে যেতে হবে।
শয়তান বানরটির দুঃসাহসের কোনো সীমা নেই। বানরটিকে একেবারে বের করে দেয়ার জন্য যত সৈন্যের দরকার হয় তা জমায়েত করো।
ঠিক আছে জাহাপনা,স্বর্গীয় জেনারেল অস্বাভাবিকভাবে বলল,আমার বলতে ভয় হচ্ছে এটা করতে আমরা অক্ষম। এই জীবটি একা যেকোন যোদ্ধার জন্য এত শক্তিশালী যে কাউকে সহজেই পরাজয় করতে পারে এবং আমরা যদি অধিক সংখ্যক সৈন্য পাঠাই তাহলে বানরও তার শরীরের কেশর থেকে সৈন্যদল গঠন করে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এমন কি আমরা যদি তাকে বন্দিও করি ,বন্দি রাখার বা ধ্বংস করার আমাদের কোন পথ জানা নেই।
তাহলে তুমিও কি আমাকে তাই বলছো? বাদশাহ মজা করে জিজ্ঞাসা করলেন,ওই বদমাশ বানরটির কাছে আমি সিংহাসন ছেড়ে দেই?
জাহাপনা,জোয়ান ইন বললেন,এটার প্রয়োজন হবে বলে আমি মনে করিনা। এমনও একজন আছেন যে বিদ্রোহী অমরদের পরাজয় করতে পারবে এবং আপনার শাসন বজায় রাখতে পারবে।
কেন পশ্চিমের স্বর্গে দূত পাঠাচ্ছেন না এবং বুদ্ধের সাহায্য প্রার্থনা করছেন না?
জাদি বাদশাহ বললেন, যদি এই দৈত্যকে পরাজিত করতে স্বর্গের সম্পদ কম হয় তাহলে আমি মনে করছি আমর আর কোন বিকল্প নেই।
মুহূর্ত পরে, মহা শুভ্রগ্রহ শুক্রের আত্মা দ্রুতবেগে একটি যাদুর মেঘে ভেসে পশ্চিমের স্বর্গের গেইটে বুদ্ধ নামলেন। পশিচমের স্বর্গে পৌঁছার একটু আগেই মাউটেইন অব মিরাকলে নামলেন। তারপর তারা থান্ডারক্লেপের মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
বুদ্ধ মহা শুভ্র গ্রহের কাছ থেকে সংবাদটি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর তিনি তার শিষ্যদের দিকে দৃষ্টি দিলেন।আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা তোমাদের ধ্যান ভঙ্গ করো না।
***
সোনালি দরজার মেঘ প্রাসাদের বাইরে,বানর তার কর্মীর মধ্যে একবার দোলে উঠছে আরেকবার নামছে। যতক্ষণ তার ধৈর্য ছিল ততক্ষণ বানর এভাবে প্যারেড করল।
তারপর বলল, সময় শেষ!কর্কশ গলায় বারন বজ্র জেনারেলকে ডাক দিল।আমি আসছি!কিন্তু যখনই বানর সামনে পা ফেললেন,একখন্ড যাদুর মেঘ তার সামনে থামলো। যাদুর মেঘ থেকে নামলেন বিশাল এক মানুষ,আলখাল্লা পরিহিত সন্ন্যাসী।
এটি কি? বানর বলল,বৃদ্ধ সন্যাসীকে বলল,তুমি কে? কেন তুমি আমার পথ আগলে দিলে?
লোকটি হাসলো, আমি সিদ্ধার্থ, লোকে আমাকে বুদ্ধও বলে। আমি তোমাকে স্বর্গের সমান সাধুও বলতে বলিনি এবং জাদি বাদশাহর স্বর্গীয় সিংহাসনও দাবি করতে বলিনি।
তা ঠিক, বানর বলল,তবে তিনি সেখানে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। অন্য কাউকেও সুযোগ দেয়া উচিত।
বুদ্ধ বললেন, তিনি চার মিলিয়ন বছর জীবনীর জন্য নিজেকে পরিপূর্ণ করেছেন দুইশত মিলিয়ন বছর সাধনা করে। তাছাড়া তুমি তো সম্পূর্ণ মনুষ্যও হতে পারো নি। তুমি কি হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছো যে স্বর্গ আর মর্ত্যের শাসক হবে?
আমার মহাশক্তি আছে। বানর বলল,আমি বাহাত্তরটি পরিবর্তনে স্নাতকত্তোর করেছি এবং আমি এক উড়াতে শতশত মাইল ভ্রমণ করতে পারি!
তাই! বুদ্ধ বললেন। তাহলে পারবে কি আমার হাতের করতলে দাঁড়াতে? এবং এ থেকে একেবারে উড়ে যেতে পারবে কি?
বানর বুদ্ধের দিকে অপলক চেয়ে রইলো, আলোর ঝর্ণাধারা আপনার মস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমি শুধু বললাম আমি শতশত মাইল উড়তে পারি। আমি কিভাবে আাপনার করতলের উপর দিয়ে লাফ দিতে পারবো না?
তাহলে আমার সাথে বাজি হোক। বুদ্ধ বললেন। যদি এক উড়াতে তুমি আমার করতল বসতে পারো তাহলে স্বর্গীয় সিংহাসন তোমার হয়ে যাবে। আমি শুধু জাদি বাদশাহকে বলব যেন পশ্চিমা স্বর্গে আমার সাথে বাস করতে আসতে। কিন্তু তুমি যদি তা না পারো তাহলে তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে এবং একাকি স্বর্গ ছাড়তে হবে।
আপনি আপনার ওয়াদা রক্ষা করতে পারবেন? বানর জিজ্ঞাসা করল।
অবশ্যই! বুদ্ধ বললেন।
তাহলে দেখুন!
বানর তার কর্মীকে বের করে আনলো তারপর বুদ্ধের করতলের উপর দিয়ে লাফ দিল যেটি আকার ছিল পদ্মপাতার মতো। তারপর বুদ্ধ জীবনের সবচেয়ে বড় লাফটি দিলেন। ডিগবাজি খেয়ে বানর বাতাসে বায়ুকলের মতো এমন গড়াগড়ি খাইলো যেন শত মাইল , হাজার মাইল চলে গেল। অবশেষে বানর আকাশের সু উচ্চে পাঁচটি জলপাই রঙের পিলার কাছে পৌঁছলো।
এটি মনে হয় স্বর্গের শেষ সীমানা। বানর নিজেকে বলল। বানর মাঝের পিলারের গোড়ায় নামল। এই বাজিতে জেতা তেমন কোন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু পেছনে কিছু প্রমান রেখে যেত হবে। বানর তার লেজ থেকে এক গুচ্ছ কেশর তুলে নিল। এবং বলল,পরিবর্তন!, কেশগুলো তার ব্রাশ হয়ে গেল এবং ভেতরে কালি ভর্তি হয়ে গেল। তারপর বানর পিলারে লিখল
‘‘বানর এখানে ছিল’’
সে কেশরগুলো তার লেজে ফিরিয়ে দিল। এপর আরেকটি জোরে লাফ দিল। এবং একমুহূর্ত পরে বানর বুদ্ধের করতলে আবার ফিরে এলো।
ঠিক আছে,বৃদ্ধ সন্ন্যাসি?, বানর বলল। এখন আপনার বাজির পণ পূরণ করুন এবং জাদি বাদশাহকে সিংহাসন থেকে নামতে বলুন।
তুমি একটা অভদ্র উল্লুক! বুদ্ধ বললেন। তুমি আমার করতলেই সারাক্ষণ থাকবে!
এ কি বলছেন আপনি! বানর বলল। আমি তো পরিস্করভাবে স্বর্গের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত উড়ে এসেছি আপনি যদি বিশ্বাস নাই করুন তাহলে আসুন দেখে যান আপনি নিজেই প্রমাণ পাবেন।
কোনোখানেই যাওয়ার দরকার নেই। বুদ্ধ বললেন, কেবল নিচের দিকেই তাকাও
বানর নিচের দিকে তাকালো এবং এখানে বানর বুদ্ধের মাঝের আঙ্গুলের গোড়ায় এই অক্ষরগুলো দেখতে পেল।
‘‘বানর এখানে ছিল’’
এটা হতে পারেনা!, বানর ঘোষণা করল। এটা একপ্রকার চাতুরী। আমি নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য চলে যাচ্ছি।
কিন্তু তার আগে বানর আবার লাফ দিল। কিন্তু বুদ্ধ তার হাত অনেক লম্বা করলেন এবং বললেন,বিশ্বাস করো বানর, এটি হচ্ছে স্বর্গের পশ্চিম গেইটের বাইরের অংশ অর্থাৎ পৃথিবী । তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে পৃথিবীতে ফেলে দিলেন। তার হাতটি পাঁচটি চূড়া বিশিষ্ট পর্বত হয়ে গেল। যেগুলোর পাথরের দেয়াল বানরটিকে চেপে রাখল। তার হাত এবং মাথাটি বাইরে কিন্তু বাকিটুকু সেই ফাঁদে আটকে আছে।

পান্থজন জাহাঙ্গীর : কবি-কথাশিল্পী ও অনুবাদক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন