খোঁজ ও বর্ণিল: সাহিত্যপত্রের মলাটভাবনা…
গাফফার মাহমুদ
বিশ শতকের গোড়ার দিকে সবচেয়ে নামী লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতো শিকাগো শহরে। লিটলম্যাগটির নাম ছিলো ‘Poetry : A Magazine Of Verse ‘( 1912)। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন কবি হেরিয়েট মনরো এবং এজরা পাউন্ড।
এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত ‘ Gentleman’s Magazine ‘ (1731) বিশ্বসাহিত্যের প্রথম লিটলম্যাগ দর্শন ইতিহাস। প্রাচ্যকলায় লিটলম্যাগ ইতিহাস শতবর্ষের ঐতিহ্য। বুদ্ধদেব বসুর মতে ‘ সবুজপত্র ‘ প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত প্রথম লিটলম্যাগ ইতিহাস চর্চা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমাত্রিক প্রতীভার অধ্যাপক—লিটলম্যাগ কর্মী, বরেন্দু মন্ডল সম্পাদিত ‘ গ্রীক কোরাসের মতো ‘ লিটলম্যাগ দর্শন এবং মূল্যবোধের পথ ধরে আরেক প্রতীভাবান গল্পকার নীহারুল ইসলাম কোলকাতা থেকে সম্পাদনা করেন ‘ খোঁজ ‘ সাহিত্য—সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা।
লিটলম্যাগ অভিযাত্রায় ‘ খোঁজ ‘র আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। একুশের টগবগে যুবা ‘ খোঁজ ‘ শিল্প-সাহিত্য স্বপ্নবানে জীবদ্দশায় কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন ‘ রফিকুল ইসলাম স্মৃতি ‘ খোঁজ ‘ পুরস্কার থেকে রবিশংকর বল, স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং নন্দিত গল্পকার জাকির তালুকদার, হামিদ কায়সার সহ সাহিত্যকীর্তিমান অনেকেই পেয়েছেন ‘ খোঁজ ‘ প্রবর্তিত পুরস্কার। বলা চলে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত, হেনরী স্বপনদের জীবনানন্দ বোধে নীহারুল ইসলাম লিটলম্যাগ ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
সম্প্রতি হাতে এলো পত্রিকাটির মাঘ ১৪২৬ | জানুয়ারি ২০২০ | ১৭তম সংখ্যা। সূচী বিন্যাসের শুরুতেই ‘ সারা ভারতেই কি বাংলা ভাষায় কথা বলা অপরাধ ? ‘ অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যের কথোপকথন। আলাপচারিতায় ছিলেন সাহিত্যজন মণিশংকর চৌধুরী। প্রাদেশিক বাংলা ভাষা সারা ভারতেই উপেক্ষিত! বিপন্ন বাঙালিদের নিয়ে সর্বদা সরব থেকেছেন ড. ভট্টাচার্য। ‘ বাংলা ভাষা এবং বাঙালিদের দুর্দশাগ্রস্ত নিয়ে উৎকণ্ঠা ‘ আমাদেরও ভাবিয়ে তোলে! ছোটগল্পপৃষ্ঠায় অংকিত হামিদ কায়সারের ‘ মোহনগঞ্জের ট্রেন ‘ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট নেত্রকোনায় চড়ে গন্তব্যে পৌঁছবেন একজন সৈকত। যাপিত জীবনের সানুপুঙ্খ গল্পভাষ্যের চিত্রকল্প বয়ন করেন নন্দিত এ গল্পকার।
‘ গর্ভবতী হলে/ পাতাগুলো হয়ে ওঠে রক্তাক্ত/ কান্ডশাখায় হাসিখুশির ফুলঝুরি— ‘ সমকালীন কবিতা পৃষ্ঠায় দ্রোহ-প্রেম, পরাবাস্তবতার নিরীখ, শিল্পভাষ্যে মুদ্রিত হয়েছে কবি শেখর আহমেদ ‘ সেই তুমি ‘ ; অরিত্র সান্যাল ‘ শব্দ ‘ ; দেবাশিস সাহা ‘ পানসিটিয়া ‘ ; মো. মনিরুজ্জামান মানিক ‘ উপসংহার ‘ ; রাজন গঙ্গোপাধ্যায় ‘ অমিত পরাক্রমশালীর প্রতি ‘ ; দীপায়ন পাঠক ‘ সম্পর্ক ‘ ; বুলবুল হাসান ‘ আমরা মানুষ ‘ ; অয়ন চৌধুরী ‘ বোধ ‘ ; সমিত মন্ডল ‘ বিরহগাথা ‘ ; সুবীর সরকার ‘ কলাবাগানে মার্কেজ ‘ ; নিলাদ্রি দেব ‘ ডায়েরি ‘ ; পাপড়ি গুহনিয়োগী ‘ নদী ‘ ; গাফফার মাহমুদ ‘ ভিক্টর সরিনের জুঁইফুল ‘ ; সুপম কর্মকার ‘ উনিশের কান্না ‘ ; মহম্মদ আলামিন ‘ এবং একটা লাল সাইকেল ‘ নতুন বাঁকবদলের কবিতা।
উনত্রিশ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘ এযাবৎ প্রকাশিত খোঁজ পত্রিকার বিষয়সূচী ‘। শেষের দুই পৃষ্ঠায় ‘ এযাবৎ খোঁজ-এর কর্মকান্ড ‘ সাহিত্য আড্ডা, রফিকুল ইসলাম স্মৃতি ‘খোঁজ ‘ পুরস্কার ভিন্ন ধারার সংবাদ প্রয়াস। প্রতুল রায় ‘ খোঁজ ‘ নামলিপি অংকিত কভার পেইজটি প্রচলিত লিটলম্যাগ থেকে ভিন্ন চিন্তা দর্শন। লিটলম্যাগ প্রকাশনা প্রয়াসে পত্রিকাটির সুদীর্ঘ একুশ বসন্তে সম্পাদকীয় ‘ এই সময়ে ক্ষুদিরাম—সুকান্ত যা করে গিয়েছেন। আমরা যেমনকার তেমনিই আছি। নিশ্চিন্ত! নির্বিকার! কিছুতেই টনক নড়ছেনা আমাদের, ফেরেনা হুঁশ! বুঝতে চাইনা ক্ষুদিরাম-সুকান্তরা কেন জন্মান? ‘
এ দায়বোধ থেকে ‘ খোঁজ ‘ উত্তরণ। সম্মানীত লেখকদের নাম তালিকা খচিত প্রচ্ছদ কভারে পত্রিকাটি সবার নজর কেড়েছে ইতিপূর্বেই। প্রায় তিন ফর্মার এ সংখ্যাটির দাম মাত্র কুড়ি টাকা। বাংলাদেশে তো নয়-ই কোলকাতাতেও এতো কমদামে লিটলম্যাগ প্রকাশনা সত্যিই বিরল। খোঁজ লালগোলা, মুর্শিদাবাদ, ভারত থেকে প্রকাশিত হয়। পাঠক হিসেবে বলবো, পত্রিকাটি সাহিত্য উত্তরণে লেখক—পাঠক মেলসূত্রের দীর্ঘসেতু পেরিয়ে যাক গঙ্গা থেকে পদ্মার।
কবি শাহমুব জুয়েল তাদের মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি হাতে এলো তার সম্পাদিত ‘ প্রজন্মের উচ্ছ্বাসে… বর্ণিল ‘ বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা।
পত্রিকাটির সূচী বিন্যাসে রয়েছে পাঠসূত্রের রসস্বাদন। পাঁচটি গবেষণা প্রবন্ধ : ‘ মুজিবের মৃত্যু কি সহজ কথা ‘ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ; ‘ বঙ্গবন্ধু ও পাকিস্তানের রাজনীতিকে অর্থনীতির ধারায় ফেরানো ‘ স্বদেশ রায় ; ‘ শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত ‘ সরকার আবদুল মান্নান ; ‘ কলকাতার আত্মজ শেখ মুজিবুর রহমান ‘ অমিত গোস্বামী ; ‘ বাঙালি চেতনার বাতিঘর ‘ পীযূষকান্তি বড়ুয়া। সমগ্র প্রবন্ধে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত শতবর্ষি ইতিহাস অধ্যায়। সূচীক্রম চলচ্চিত্র বাতায়নে লিখেছেন মানবেন্দ্রনাথ সাহা ‘ বাংলা ছবির চিত্রনাট্য ‘ তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ। ইতিহাস ও ঐতিহ্য পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে ড. শামস্ আলদীন ‘ ১৭ এপ্রিল ইতিহাস ও অর্জন ‘ ; শাহীন চৌধুরী ডলি ‘ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ‘ ; করীম রেজা ‘ বঙ্গবন্ধু এবং জয়বাংলা ‘ ; ইমাম মেহেদী ‘ বঙ্গবন্ধুর যত অলংকার ‘ ; ফখরুল হাসান ‘ কিংবদন্তিদের চোখে বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু ‘ ; মানিক বৈরাগী ‘ শ্রুতিতে বামধারা একাত্তর : প্রেক্ষিত কক্সবাজার ‘ ; শাহমুব জুয়েল ‘ তারুণ্যে : বঙ্গবন্ধুর প্রভাব ‘ লেখাগুলো সামগ্রিক বিবেচনায় ইতিহাস আশ্রিত ঐতিহ্যের সুবর্ণ প্রয়াস।
গবেষণা দ্বিতীয় ভাগ সূচীত প্রবন্ধ লিখেছেন তছলিম হোসেন হাওলাদার ‘ আমি বিজয় দেখেছি ‘ ; প্রকৌ. মো. দেলোয়ার হোসেন ‘ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশার বাংলাদেশ ‘ ; পিয়াস মজিদ ‘ মহাজীবনের কারাভাষ্য ‘ ; জাহাঙ্গীর হোসেন ‘ রাজনীতির গতিধারায় বঙ্গবন্ধু ‘ সত্যসন্ধানী বঙ্গবন্ধুর অলিখিত ঘটনা প্রবাহ যা পাঠক মাত্রই পড়তে চাইবেন নিমিষেই। চারপৃষ্ঠার অনুবাদ : লেখক আনোয়ার এ খান ‘ বঙ্গবন্ধু : রাজনীতির কবি ‘ মূল প্রবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন।
সূচীক্রম দু’টি বই আলোচনা ‘ শামস সাইদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর : মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে বঙ্গবন্ধু বয়ান ‘ মিল্টন বিশ্বাস ; ‘ আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘ বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন ‘ বিশ্লেষণে-পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ‘ মুহাম্মদ ফরিদ হাসান দু’জনই লিখেছেন বইয়ের কোরাস। রয়েছে ইকবাল পারভেজ এবং গাফফার মাহমুদের গুচ্ছ কবিতা। আরও আছে দুই গল্পকারের গল্পঅন্তর্ভুক্তি তেরপৃষ্ঠা। ইসহাক খান ‘ বড় মানুষ ‘ ; মনি হায়দার ‘ কর্ণেল আসছেন ‘ গল্পসমগ্রে আছে ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধ, বুর্জোয়া ব্যুরোক্রাট শাসননীতি দুইয়ের উপাখ্যান।
কবিতার প্রথম ভাগ কবিতা লিখেছেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, নূহ-উল-আলম লেনিন, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, মাহফুজ আল-হোসেন, লুৎফর চৌধুরী, নাজনীন হাবীব, দ্বীপ সরকার, তোফায়েল তোফাজ্জল, ফারুক সুমন এবং দ্বিতীয় ভাগে লিখেছেন বঙ্গ রাখাল, বাপ্পি সাহা, বিটুল দেব, মিজান মনির, মীম মিজান, সাইয়্যিদ মঞ্জু, রুদ্র সাহাদাৎ, পার্থ মল্লিক, শারমীন সুলতানা রীনা ও আইরিন সুলতানা লিমা প্রমুখ। রয়েছে পুঁথি বিষয়ক কবিতা ‘ বিজয়ের পতাকা ‘ লিখেছেন পুঁথিবিশারদ কবি জালাল খান ইউসুফী। একশত চুচল্লিশ পৃষ্ঠার ১০০গ্রাম অফসেট কাগজে মুদ্রিত ৫২ জন লেখক সমৃদ্ধ করেছেন এ সংখ্যাটি। আল নোমানের মুক্তিযুদ্ধ চেতনার রঙিন প্রচ্ছদ এবং সাবিনা ইয়াসমিন সেতুর নামলিপি ‘ বর্ণিল ‘ এ সংখ্যার মূল্য : একশত পঞ্চাশ টাকা মাত্র। মুজিববর্ষ ইতিহাস নির্ভর ‘ বর্ণিল’ও ইতিহাস সাক্ষী সুবর্ণ অধ্যায়ে। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় শ্রুতিভাষ্য ‘ চেতনার বাতিঘর জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গকন্যা, অবিনাশী চেতনা এবং শ্রদ্ধাশীল শিল্পানুরাগীদের উদ্যোগ, গড়ে ওঠে আরেক বাংলাদেশ ‘ এ বাংলাদেশ সর্বধর্মাশ্রিত, অসাম্প্রদায়িক চেতনাউজ্জীবিত বাংলাদেশ। আমাদের দরকার বর্ণিলের মতো সুফলার বীজতলা গড়ে উঠুক আরেক ব-দ্বীপ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। সমৃদ্ধ এ প্রকাশনা দুটি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।
বর্ণিল | সংখ্যা : ০৪ | মাঘ ১৪২৬ | ফেব্রুয়ারি ২০২০ প্রকাশিত হয় কুমিল্লা রোড, চাঁদপুর, বাংলাদেশ থেকে।
গাফফার মাহমুদ: কবি।
বিনয় মজুমদারের জায়গায় নবারুণ ভট্টাচার্য হবে। প্লিজ সংশোধন করে নিন।