তারিখ…

রেফায়েত কবির শাওন

হালে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। লাইট পলিউশন। আধুনিক শহরে আলোর ঝলকানি এত বেশি যে, এই আলোর চাপে স্বর্গীয় আলো দেখা যায় না, ফলে আকাশের তারা গোনা এখন আর কঠিন ব্যাপার না। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে ব্যাপারটা এমন ছিল না। তাঁরা মেঘহীন আকাশে তারা দেখতে দেখতে আবিস্কার করলেন সৃষ্টির চলার পথ বৃত্তাকার। এই চন্দ্র সূর্য পৃথিবীর অবিরত ঘূর্ণনকে হিসেব করে বের করলেন দিন মাস সালের হিসেব। এখন আমরা আর এই হিসেবের যাঁতাকল থেকে বের হতে পারছি না।

মাসের শুরু, বের করুন হিসেবের খেরো খাতা। ইউটিলিটি বিল থেকে শুরু করে বাড়ি ভাড়া – বাচ্চার স্কুলের বেতন থেকে শুরু করে পাড়ার দোকানে মাসকাবারি বাকি পরিশোধ। মনে হয় তারিখটা গত মাসের শেষ দিনে আটকে গেলে কতই না ভাল হত। বছরের শুরুতে ব্যাপারটা আরো ভয়ন্কর হয়ে দাঁড়ায়। বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়াবে, বাচ্চার স্কুলের পূনঃভর্তি, বই কেনা, স্কুলের কাপড় বানানো। তারপরও আমাদের কাছে নিউ ইয়ার আনন্দের।

বছরের মাঝামাঝি এসে যে একটু শ্বাস ফেলবেন তারও কোন উপায় নেই। সৌরবছর, চন্দ্রবছর যখনই শুরু হোক না কেন, অর্থ বছর শুরু বছরের মাঝ বরাবর। গলা চেপে ধরবে এনবিআর। আয় করেন আর না করেন আয়কর আপনাকে দিতেই হবে। আর যদি আপনি ছোটখাট ব্যবসায়ী হোন তবেতো কথাই নেই। কিছু কিনতে ভ্যাট, বেচতেও ভ্যাট, এমনকি স্কুলের বেতনেও ভ্যাট। শিক্ষা পণ্য নয় বলে সরকার স্কুলের বেতন নির্ধারণ করে দেন, আবার শিক্ষাকে পন্য বানিয়ে ভ্যাটও নেন।। ইদানিং এর সাথে যুক্ত হয়েছে লাইসেন্স। আগে মানুষ ব্যাবসা করত সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে, এখন তার সাথে লাগে ফায়ার লাইসেন্স, শ্রম লাইসেন্স, ডিলিং লাইসেন্স, পরিবেশ লাইসেন্স সহ হাজারো লাইসেন্স। ভবিষ্যতে আমরা লাইসেন্স বিদেশেও রপ্তানী করতে পারব বলে আশা করি।

তবে দিন তারিখের ব্যাপারে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। একসময় স্ত্রীর বার্থডে, ম্যারেজডে ভুলে গেলে, স্বামী বেচারার বেহাল অবস্থা হত। আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে এসব জিনিস মনে রাখতে আর মস্তিস্ককে চাপ দিতে হয় না। শুধু নিজের স্ত্রী না, বসের স্ত্রীর বার্থডেও এখন আপনি চাইলেও ভুলতে পারবেন না। ভবিষ্যতে এসব সোশ্যাল মিডিয়া আর কি কি ব্যাক্তিগত ব্যাপার মনে করিয়ে দেবে কে জানে।

এখন বাজারে গেলে বোঝা যায় মানুষ তারিখ নিয়ে কতটা সচেতন। ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের কারণে মানুষ বুঝতে শিখেছ এদেশের বাজারে অনেক জিনিষই মেয়াদউত্তীর্ণ। এসব জিনিষ খেলে বা ব্যবহার করলে নানা রোগ হতে পারে। তাই এখন সবাই কিছু কেনার আগে জিনিসের গায়ে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ দেখে কেনেন। প্রোডাক্টের গায়ে ছোট লেখা পড়তে সমস্যা হয় বলে অনেকেই ডাক্তার দেখিয়ে প্লাস পাওয়ারের চশমা নিয়েছেন।

এক ভদ্রলোককে চিনি, তিনি একটি বিশেষ বেকারির পাউরুটি কেনেন। এবং ওই অখ্যাত বেকারির পাউরুটি না পেলে তাঁর মেজাজ চড়ে যায়। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালেন, অন্য সব বেকারির পাউরুটিতে মেয়াদ থাকে দুই দিন, আর তিনি যে বেকারিরটা কেনেন তাতে মেয়াদ থাকে এক সপ্তাহ। বুঝুন ব্যাপারটা এক সপ্তাহ মেয়াদ থাকা মানেই তাঁর কাছে জিনিসটা ভাল। আবার এর উল্টোটাও আছে, কেউ কেউ কেনেন উতপাদনের তারিখ দেখে। তাঁদের কাছে মেয়াদ যতদিনই থাকুক না কেন, উতপাদন বেশি আগে হলে সে পন্য ভাল না। অনেক গবেষণা করেও বুঝতে পারিনি একই জিনিসে একেক কম্পানীর পণ্যে একেকরকম মেয়াদ থাকে কেন। ডায়েপারের কথাই ধরুন না। পেম্পার ব্যান্ডে মেয়াদ থাকে তিন বছর আর চুচু ব্র্যাখন্ডে দশ বছর।

এক সচেতন ভ্রদ্রমহিলার ভাই বিদেশে থাকেন। অনেক বছর পর দেশে আসার সময় নিয়ে এসেছেন নামী দামি সব ব্র্যামন্ডের কসমেটিকস। মহিলা এগুলো নিয়ে খুশি তো হলেনই না বরং মায়ের পেটের ভাই কে সন্দেহ করতে লাগলেন। কারণ তার আনা কসমেটিক্সগুলোর বেশিরভাগেই কোন এক্সপায়ারী ডেট লেখা নেই। যদিও সব জিনিসেই লেখা আছে ছিপি খোলার পর থেকে কতদিন ব্যবহার করা যায় তার হিসেব, কিন্তু নির্দিষ্ট সন তারিখ না থাকায় তাঁর সন্দেহ যায় না। ভাই যতই তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই কেমিকেল প্রোডাক্টগুলো বেশিরভাগই নন বায়োডিগ্রেডেবল এবং সভ্য দেশের আইনে সব পন্যে নির্দিষ্ট নিয়মে মেয়াদ দিতে হয় যেনতেনভাবে এক্সপায়ারি ডেট বসালেই হয় না, বোন কিছুতেই বোঝে না।

মুদির দোকানী হওয়ায় ব্যাপারটা আমাকেও ভাবনায় ফেলে দিল। সর্বনাশ, এসব জিনিষ দোকানে থাকলেতো ভ্রাম্যমান আদালত জেল জরিমানা করে দেবে। দৌড়ে গেলাম দোকানে, না আমার এখানে সব জিনিষেরই মেয়াদোর্তীর্ন তারিখ আছে। এমনকি বিখ্যাত প্রোক্টর এন্ড গেম্বলের আমদানিকৃত হেড এন্ড শোলডার, পেন্টিনের মত ব্র্যাভন্ডের পন্যগুলোতে আর সবকিছু ইংরেজিতে লেখা হলেও মেয়াদের তারিখ খানা নিখাদ বাংলায় লেখা। খোঁজ নিয়ে জানলাম, তারিখ নিয়ে আমাদের অদ্ভুত আইন আর অতি উতসাহের কারণে আমদানীকারকরা সব পণ্যেই আন্দাজে তারিখের একটা সিল মেরে দেন। একটু মাথা খাঁটালেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর।

কথায় আছে পুরান চাল ভাতে বাড়ে। আচ্ছা আমরা এখন ভাতে বাড়া চালের ভাত কিভাবে খাব, তার যে এক্সপায়ারি ডেট থাকবে না। খোলা চাল, চিনি এগুলোর মেয়াদ আমরা কিভাবে বুঝব? ন্যানো টেকনোলাজি ব্যবহার করে প্রতিটি চালের গায়ে মেয়াদোর্তীর্ তারিখ বসানো যেতে পারে।

কোথায় যেন পড়েছিলাম মধু নেচারাল প্রিজারভেটিল। কেউ কেউ বলে মধু ঘি এগুলো পুরোণ ভাল। বাজারে গিয়ে দেখলাম, দেশি বিদেশি সব ঘি মধুর গায়ে মেয়াদোর্তির্ সিল দেয়া। আচ্ছা এই দেশে কি মদেরও এক্সপায়ারি ডেট থাকে? শুনেছি এ জিনিষ যত পুরোন হয় তত স্বাদেও বাড়ে, দামেও বাড়ে। আসক্তি নেই বলে, কখনো কেনা হয়নি। অবশ্য মদের দোকানে অভিজানের খবর কাগজে কখনও পড়িনি।

জন্মতারিখের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যাতিক্রম। কোন এক অদ্ভুত কারণে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্মতারিখ ১লা জানুয়ারী। এদেশে আবার অনেকের বেশ কয়েকটা জন্মতারিখ থাকে। সরকারী চাকরির বয়সসীমার অদ্ভুত নিয়মের কারণে। স্কুলে ভর্তির সময় বয়স কমিয়ে দেয়া হয় কয়েকবছর। আর এই অফিসিয়াল জন্মতারিখটা ব্যাবহার করতে হয় সবখানে, শুধু পারিবারিক জন্মদিন উদযাপনটা থাকে আসল তারিখে। আজকাল ব্যান্কগুলো তাদের বড় ক্লায়েন্টদের আর ঋণ খেলাপীদের জন্মদিনে কেক পাঠায়। আর অফিসিয়াল জন্মদিনে পাঠানো সেই কেক দেখে অনেকে অবাক হয়ে যান, কারণ তাদের মনেই থাকে না যে কাগজে কলমে ওটি তাঁর জন্মদিন।

নকিয়া – মটরোলার ফোনে ক্যালেন্ডার আসল। মস্তিস্কের কোষে বন্ধুর জন্মদিন টুকে রাখার দিন শেষ হল। মোবাইলের ক্যালেন্ডারে একবার ঢুকিয়ে দিলেই হল। বছর বছর মনে করানোর দায়িত্ব এখন মেশিনের। রাত বারটায় মোবাইলের ক্যালেন্ডারে জন্মদিনের এলার্ম বেজে উঠতেই শুরু হত এস এম এস নিক্ষেপ। বেছে বেছে বন্ধুর রুচি বুঝে কার্ড কেনা, দু’চার পঙতি ছন্দে গোট গোট হরফে অনুভূতির কথা লেখা – সব এসে ঠেকল মাঝ রাত্রিরে ১৬০ অক্ষরের মেসেজে। এস এম এস সস্তা হওয়ায় বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে গেল। রাতের অর্ধেকটা কাটতে লাগল মোবাইলের টূংটাং এ। নিজের জন্মদিনে ঘুমটাই হারাম হল।

প্রযুক্তি আরো উন্নত হল। এখন আর ফিচার ফোনের ক্যালেন্ডারে বন্ধুর জন্মদিন ইনপুট দিতে হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই নিজেই নিজের বার্থডে লিখে দেয়। আর তা দেখেই উইশ করে বন্ধুরা। উইশ করতেও কষ্ট নেই। নানা রকমের টেমপ্লেট করা আছে। মানানশই একটা সিলেক্ট করে বাটনে একটা চাপ দিলেই হল। মজার ব্যাপার হল কারো ফেসবুক প্রোফাইলে বার্থডে উল্লেখ না থাকলে এখন তার বার্থডে আর কেউ মনে রাখে না, সে হয়ে যায় নন এনটিটি। আচ্ছা কোন কারণে যদি একবছরের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ থাকে, সে বছর কি কেউ কাউকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাবে না?

রেফায়েত কবির শাওন:প্রভাষক,ইংরেজি। সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজ। চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন