পুবাকাশ পরিবার
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (জন্ম: ২৫ জুলাই, ১৯৩৯) বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। তিনি ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে পরিচিতি পান। সে সময়ে সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসাবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
আবু সায়ীদ ১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারী বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ।
এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন। আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, তিনি ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। এ সময় কিছুকাল বাংলাদেশে টেলিভিশনে উপস্থাপনাও করেন।
আবু সায়ীদ ১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে সায়ীদ বলেন:
দেশের এই সার্বিক অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাহীনতার ভেতর সীমিত সংখ্যায় হলেও যাতে শিক্ষিত ও উচ্চমূল্যবোধসম্পন্ন আত্মোৎসর্গিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ বিকশিত হওয়ার পরিবেশ উপহার দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন, মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা-কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে- আমরা এখানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। কাজেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাণহীন, কৃত্রিম, গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন-পরিবেশ।
বাংলাদেশে পাঠাগারের অপ্রতুলতা অনুধাবন করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ১৯৯৮ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কার্যক্রম শুরু হয়।
এ মহান কীর্তিমানকে ৮১ তম জন্মদিনে পুবাকাশ পরিবারের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
স্যারকে নিয়ে তরুণ চিন্তক চিন্তাযান সম্পাদক
জগলুল আসাদ এর লেখাটি পুবাকাশের পাঠকের জন্য।
প্রতিটি বাক্যে আলাদা আলাদা মনোযোগ দিয়ে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মত এমন সযত্ন গদ্য আর কে লিখেছে! তার অনেক বাক্য প্রবাদের উচ্চতা অর্জন করেছে। ‘দুর্দিনে টিকে থাকা সুদিনে বিপ্লবের সমান’, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়ো’ ইত্যাদি বাক্যনিচয় শ্রেণীকক্ষ ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতায় নিত্য ব্যবহার করে লোকে। এ মানুষটির তীক্ষ্ণ রসবোধ আর সূক্ষ সাহিত্যিক সংবেদনশীলতা চমৎকৃত করবে যে কাউকে ।
সাহিত্য সমালোচনামূলক যতগুলো গদ্য তিনি লিখেছেন, মানে ও উচ্চতায় সেগুলোর সমতুল্য লেখা এ- দেশে কমই চোখে পড়েছে । ১৯৭০ সালে প্রকাশিত আব্দুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ও জ্যোৎস্না -রৌদ্রের চিকিৎসা, ১৯৭৫ এ রফিক আজাদের ‘অসম্ভবের পায়ে’ কাব্যগ্রন্থের অসাধারণ পর্যালোচনা তিনি করেছিলেন । সমসাময়িক কালের সাহিত্য নিয়ে এমন নিবিড়, অন্তর্ভেদী ও বস্তুনিষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনা এখন দুর্লক্ষ্য । ফেসবুকীয় বাকবিস্তারে নিজের ঢোল নিজেই বাজিয়ে যাওয়ার সাহিত্যিকতাকে বাদ দিলে সমসাময়িক সাহিত্য এ দেশে বহুদিন থেকেই কোন পর্যালোচনারই অধীন নয়। সাহিত্যর মান ও উচ্চতা উপলব্ধি করার, ও তা প্রকাশ করার উপযুক্ত মনীষার অভাব প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। বন্ধুদের ও সমকালের রচনা নিয়েও যে বস্তুনিষ্ঠ,সুলুকসন্ধানী আলোচনা সম্ভব, ও সাহিত্যপ্রতিভার চারিত্রলক্ষণ নিপুণ ও আন্তরিক পর্যবেক্ষণে যে উন্মোচন করা যায়, এই শিক্ষা নিতে পারি আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছ থেকে। বাংলা গদ্যের শক্তি ও সুরটুকু বুঝে নিতে,ও সাহিত্যের সৌন্দর্য উপলব্ধি ও সংবেদনশীলতা অর্জনে তার লেখা ও কথার কাছে তারুণ্যকে মাঝে মাঝে ফিরে তাকাতে হয় ! তাঁর গদ্য নির্মেদ নয়, বিশেষণ ব্যবহারে তিনি প্রায় অক্লান্ত। পাঠককেও তিনি ক্লান্ত করেন না।
জ্ঞান ও পান্ডিত্য কি করে শৈল্পিক হয়ে উঠে,অনবরত অনুভববেদ্য কথকতা কি ক’রে প্রজ্ঞাসিক্ত ব’লে মনে হতে পারে, তার কিছু আলোকোচ্ছটা দেখিয়েছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ । অনেকের কাছে তো তার কথা ও উপস্থিতিও শিল্পের অনুভব দেয়।
আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য ছিলাম না কোনদিন। স্যারের সহবতও পাইনি। তাঁকে জানি তাঁকে কিছুটা পাঠের মধ্য দিয়ে । কলকাতাবাহিত সাহিত্যরুচির সমঝদার তিনি। সায়ীদ স্যার সাহিত্যকে প্রায় ধর্মের বিকল্প ভাবা মানুষ । সাহিত্যপাঠ প্রার্থনার সমতুল্য তাঁর কাছে। এইদিক দিয়ে ম্যাথু আর্নোল্ডীয় ভিকটোরিয়ান সাহিত্য চৈতন্যের বাহক তিনি। পাঞ্জাবি আর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের মধ্য দিয়ে এক সুমিষ্ট-স্নিগ্ধ সাহিত্যিক আবহ তিনি ধারণ করে থাকেন নিজ অবয়বে । প্রধানত সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়েই আলোকিত মানুষ তৈরি হয়, এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে তাঁর নিঃসংকোচ আস্থা। তিনি তাঁর বই পড়া কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যে প্রজন্ম গড়ে তুলবার কোশেশ করেছেন, তাদের মুক্তি প্রধানত তাঁর ও তাঁর প্রতিষ্ঠানের সম্মোহন থেকে মুক্তি লাভের মধ্য দিয়েই সম্ভব! কোন মহৎ চিন্তার দিশারি ও ধারক না হয়ে ভাষা যদি শুধু ধ্বনিময়তায় আর সুখদ কোমল অনুভুতিতেই ফুরিয়ে যায়, তবে তা কি করে আলোকপ্রদায়ী হয়? কোন আলো এই “আলোকিত মানুষ”-এর প্রকল্প ছড়াতে না পারলেও বহু তরুণ প্রাণকে হয়তো ফিরিয়ে রেখেছে কিছু নীল ছোবলের হাত থেকে। বই পড়া নিজেই একটা কাজ, গ্রন্থপাঠ নিজেই এক আলোকক ও আলোকিত তৎপরতা— এই সত্য-মিথ্যা বোধ তিনি ছড়াতে পেরেছেন । তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান কোন উন্নততর ও মহাজীবনের ইশারা দিতে ও তৈরি করতে না পারলেও ‘বাঙালিত্ব’ ও আন্তর্জাতিকতার মৃদু মিশেলে তিনি তৈরি করেছেন তাঁর অ/রাজনৈতিক “রেনেসাঁস প্রকল্প”।
মানুষ সত্যিকারে কী করে আলোকিত হয়, কোন প্রদীপের আলোতে দীপ্যমান হ’য়ে সে নিজেই হয়ে ওঠে প্রদীপসম, ইতিহাসের বৃহৎ পরিমন্ডল থেকে সেই অনুসন্ধানের তাড়না তৈরি হয় কিনা তাঁর উদ্যম ও আয়োজন থেকে, সেই প্রশ্নটুকু থেকেই যাবে।
তবে, বঙ্গবাসী যখন প্রায় সব প্রতিষ্ঠান খুইয়ে চাপা গোঙানিতে মৃতবৎ পড়ে থাকে, তখনও তাঁর স্বহস্তে নির্মিত প্রতিষ্ঠান দন্ডায়মান থাকে স্বমহিমায় । কী করে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়, টিকিয়ে রাখা যায় তার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে সায়ীদ স্যারকে কেউ কেউ দিশারি ভাববেন, নিঃসন্দেহে। টিভি উপস্থাপক হিসেবে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকেও মনে পরবে অনেকের।
ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর তিনি শেষ জাতীয় স্যার হিসেবে টিকে থাকুন আরো বহুদিন, উপভোগ করুন বেঁচে থাকাকে , আর জীবনের এই প্রায় শেষ লগ্নে যদি মহাজীবনের কোন ইশারা বুকে বেজে ওঠে , তবে তা নিঃসংকোচে বলে যাবেন আপনি, এই প্রত্যাশা করি।