দারবিশ্-এর রমণীগণ


পাহাড়ী ভট্টাচার্য।। পুবাকাশ


Nothing is harder on the soul, than the smell of dreams, while they’re evaporating.
– Mahmoud Darwish

মাহমুদ দারবিশ্-এর জীবনের সাথে যুক্ততা ছিলেন চার নারী। মা হুরাইয়া দারবিশ্, তাঁর দুই স্ত্রী; ব্রিটিশ-সিরীয় কবি রানা কাব্বা্নী ও মিশরীয় অনুবাদক হায়াত হিনি ও প্রথম প্রণয়িনী ইসরায়েলী বংশোদ্ধুত ইহুদী নারী-তামার বেন অ্যামি- যাকে “রিটা”- ছদ্মনামে-ই সম্বোধন করেছেন দারবিশ্, তাঁর কবিতায়। এঁদের প্রত্যেকের প্রভাব কবি-র যাপিত জীবন, রাজনীতি ও বোধ-কে প্রভাবিত করেছে, নানান মাত্রিকতায়। দারবিশ্ কবিতায়-গদ্যে-স্মৃতিকথায় তুলে এনেছেন তাঁদের কথা, অল্প-বিস্তর।


মাহমুদ দারবিশ্-প্যালেস্টাইনের জাতীয় কবি। মধ্যপ্রাচ্যে ও আরব বিশ্বে তো বটেই, ইউরোপ-এশিয়ার দেশে দেশে কবিতাপ্রেমী ও সাহিত্য-প্রিয় মানুষদের কাছের একজন। স্বদেশ ও মানুষের ভবিতব্য এবং সমকালকে দারবিশ্ চিত্রিত করেন তাঁর অনবদ্য স্বকীয় ভঙ্গীমায়, শব্দবন্ধে, ছন্দে-রূপকে-উপমায়, নির্মাণ-এর নিজস্বতায়, তীব্রতর বোধে ও ধ্রুপদী স্বাতন্ত্র্যে।

অদ্যাবধি ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর ৩০টি কাব্য গ্রন্হ, গোটা ৮ গদ্য ও অন্যান্য রচনাবলি। দারবিশ্ শুধুই সাহিত্যে নয়, সমকালীন রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজদর্শন, ক্রমাগত বিবর্তনশীল আরবীয় ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে অনিবার্য এক চরিত্রও; যাপনে-মননে, সৃজনধর্মীতায়।

মাহমুদ দারবিশ্-এর কবিতায় স্বদেশের জন্য আকুলতা, এক ছিন্নমূল মানুষের মনোদৈহিক যন্ত্রনার ইতিবৃত্ত এবং নির্বাসিত ব্যক্তি-সত্ত্বা, বিলুপ্ত ঐতিহ্য-ইতিহাস-সময় ঘিরে সুতীব্র ভাবাবেগ যেমন একদিকে প্রবলভাবেই উপস্হিত, তেমনি অন্যদিকে, মানবিক বোধের ও প্রবলতর সংবেদী মননের বহি:প্রকাশও সমভাবে দৃশ্যমান। দারবিশ্, সযত্নে তাঁর কবিতা-র ক্যানভাস জুড়ে এঁকেছেন নারী-অবয়ব ও স্বদেশ-এর ছবি, উভয়ের বহুমাত্রিক সত্ত্বাকে।

নারী কখনো স্বদেশ হয়ে, কখনো বিরূদ্ধ-শ্রোতের বিরূদ্ধে দাড়ানো লড়াকু মানবী রূপে, কখনো নিতান্তই প্রিয়তমা-র আদলে, কখনোবা মাতৃত্ব-সমেত রক্ত-মাংশের সতেজ, দৃঢ় অমোঘ মোড়কে উঠে এসেছে দারবিশে্র কবিতায়।

“We suffer from an incurable malady : Hope.”
– Mahmoud Darwish

মূলত: দারবিশ্-এর ৬৭ বৎসরের জীবন-পর্বটি কেটেছে ইসরাইল ও অধিকৃত ফিলিস্তিন, মিশর, লেবানন, মস্কো, তিউনেশীয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে। দারবিশ্ ১৯৪১-এর ১৩ মার্চ আল-বিরউয়া-য় (ইসরাইলের গালিলি নামক পর্বত-বেষ্টীত অংশে) এক ভু-স্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-মা খুব বেশী পড়াশুনা জানতেন না। পিতামহের পাঠাভ্যাসই তাঁকে পড়াশুনায় আগ্রহী করে। ১৯৪৮ সালে তাঁদের গ্রামে ইসরায়েলি সেনা-অনুপ্রবেশ ঘটলে পরিবারটি অনেকটাই “আভ্যন্তরিন উদ্বাস্তুু”- তে পরিণত হয়, পাড়ি দেয় লেবানন। পরে ফিলিস্তিনে ফিরে এলেও দারবিশ্ তাঁদের গ্রাম ও জন্মভিটা-টি আর খুঁজে পান নি। যুদ্ধে, রক্তপাতে আমূল বদলে যাওয়া পরিপার্শ্ব ঘিরেই কাটে দারবিশ্-এর কৈশোর-তারুণ্য। দারবিশ্-কে, তাঁর জন্মভূমিতে-ই পরিচয় গোপন রেখে ভর্তি হতে হয় বিদ্যালয়ে। নিরন্তর একটি আত্মপরিচয়ের সংকটে থাকা উদ্বাস্ত্তু জীবনের নানামাত্রিক অনিশ্চয়তায় কাটে তাঁর ছেলেবেলা। ১৬ বছর বয়সে ইসরায়েলী সেনাদের হাতে গ্রেফতারের ফলে মা-বাবা ও পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্নতা, উত্তরকালে আত্মগোপন, পলাতক ও গৃহ-বন্দিত্বের কাল পর্বটি দারবিশ্-এর জীবনে সবিশেষ স্মর্তব্য। মা’-র জন্য দারবিশ্-এর এক সুগভীর অভিমান-জাত আকুলতা ছিল আমৃত্যুই।

স্বদেশ ও মাতৃরূপ অভূতপূর্ব দ্যোতনায় ধরা দেয় দারবিশ্ -এর কবিতায় :

“I long for my mother’s bread
My mother’s coffee
Her touch
Childhood memories grow up in me
Day after day
I must be worth my life
At the hour of my death
Worth the tears of my mother.
And if I come back one day
Take me as a veil to your eyelashes
Cover my bones with the grass
Blessed by your footsteps
Bind us together
With a lock of your hair
With a thread that trails from the back of your dress…”

দারবিশ্-এর কবিতার প্রতি অনুরাগ জন্মে বালকবেলায়। ১৯ বছর বয়সে বেরোয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ “উইং-লেস বার্ডস”। ইসরয়েল-এর কম্যুনিষ্ট পার্টির তরুণ এ্যক্টিভিষ্ট- দারবিশ্-কে রাজনীতির চাইতেও বেশী আকর্ষণ করতে থাকে সাহিত্য। ক্রমে, পার্টির সাহিত্যপত্র সম্পাদনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে লেখালেখি, সম্পাদনার কাজ। ১৯৭০-এ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান দারবিশ্। অত পর, যুক্ত হন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন-এর সাথে। দীর্ঘসময় ইয়াসির আরাফাত সহ পিএলও-র শীর্ষ- নেতৃত্বের সাথে কাজ করেন দারবিশ্, দেশে-বিদেশে। পরে পিএলও তাঁকে মন্ত্রীত্ব দিতে চাইলেও তিনি নেন নি। এক পর্যায়ে, অসলো শান্তিচুক্তিকে কেন্দ্র করে পিএলও এবং আরাফাতের সাথে দুরত্ব তৈরী হয়, দারবিশ্ সক্রিয় রাজ-নৈতিক তৎপরতা থেকে দুরে সরে আসেন, নিজেকে যুক্ত রাখেন আমৃত্যু সাহিত্যে, সাংবাদিকতায়, লেখালেখি ও বক্তৃতা, পঠন-পাঠনে, একাডেমিক উদ্যোগ-তৎপরতায়।

১৯৪৮-এ ইসরাইল ফিলিস্তিনের ব্যাপক ভুখন্ড নিজেদের দখলে নিলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি সীমান্ত পার হয়ে অাশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। ইসরাইলেই উদ্বাস্ত্তু জীবন কাটে দারবিশ্-দের মত অনেকেরই। ইসরাইল-এর হাইফা-তে বসবাসকালীন সময়ে দারবিশ্-‘র পরিচয় ঘটে একদা ইসরায়েলী কম্যুনিষ্ট পার্টির মিছিলে আসা রিটা-র সাথে। তাঁদের পাষ্পরিক সম্পর্ক ১৯৬৭ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও অটুট ছিল। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ধারাবাহিকতায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসরাইল-কর্তৃক ফিলিস্তিনে আগ্রাসন, দমন-পীড়ন এবং অধিগ্রহন দু’জনকে বিচ্ছিন্ন, পৃথক ভূ-খন্ডের অধিবাসীতে রুপান্তরিত করলে এ সম্পর্কসূত্রের দৃশ্যমান ইতি ঘটে। “রিটা এন্ড রাইফেল”কবিতায় দারবিশ্ লেখেন

“Between Rita and my eyes…
There is a rifle
And whoever knows Rita
Kneels and plays To the divinity in those honey-colored eyes
And I kissed Rita When she was young
And I remember how she approached
And how my arm covered the loveliest of braids
And I remember Rita
The way a sparrow remembers its stream
Ah, Rita Between us there are a million sparrows and images
And many a rendezvous…”

দারবিশ্-এর প্রথম প্রেমিকা তামার বেন আ্যমি ওরফে রিটা কালপরিক্রমায় ইসরাইল ছেড়ে জার্মানীতে থিতু হন। দারবিশ-এর লেখা অসংখ্য পত্রাবলি রিটা সুদীর্ঘ কাল গোপনে রাখেন সযত্নে, নিজের কাছে, স্মৃতিচিন্হ হিসেবে। ১৯৬৪-তে “রাইট ডাউন, আই এম এন এরাব” শিরোনামের দারবিশ-এর সাড়া জাগানো কবিতার জন্য জেলবন্দিত্বের সময় রিটা সব বাধা উপেক্ষা করে কবির সাথে যোগাযোগ রাখতেন। একাধিক সাক্ষাতকারে রিটা দারবিশ্-এর সাথে প্রণয় এবং ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংকট বিষয়ে স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। প্যারিসে, দীর্ঘদিন পর উভয়ের সাক্ষাতও ঘটে একবার, পরবর্ত্তীকালে।

ব্রিটিশ-সিরীয় কবি, সাংষ্কৃতিক-ইতিহাসবেত্তা ও লেখক রানা কাব্বা্ানী-র সাথে দারবিশ্-এর দাম্পত্য-সম্পর্কটি ছিল ১৯৭৬-১৯৮২ অবধি। রানা-র সাথে কবি-র দুবারই বিয়ে ও বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটে! দারবিশ্-এর কিছু কবিতাও ইংরেজীতে অনুবাদ করেন রানা কাব্বা্নী “স্যান্ডস্ এন্ড আদার পোয়েমস”-শিরোনামে। ইংল্যান্ডে ২ সন্তান সমেত ব্রিটিশ সাংবাদিক স্বামী প্যট্রিক সিলকে নিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে রানা-র জীবন, এখন।

ইসরাইলীদের চোখে দারবিশ্-এর কবিতা ও রাজনৈতিক তৎপরতা সবসময়ই ছিল প্রবল উদ্বেগ-উৎকন্ঠার কারণ, কবি-র জনপ্রিয়তাও ছিল অধিগ্রহণকারী শাসকগোষ্টী-র জন্য অস্বস্তিকর। ফলে, ২৩ বছর ইসরাইলে কিংবা নিজ জন্মভূমিতে দারবিশ্ ছিলেন অচ্যুত, অনাকাঙ্খিত মানুষ। আত্মগোপনের কালে, মিশরের কায়রোয় বসবাসকালীন সময়ে দারবিশ্-এর পরিচয় ও প্রণয় ঘটে অনুবাদক এবং সম্পাদক হায়াত হিনি-র সাথে। পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলে-ও তাঁদের দাম্পত্য বছরাধিককালের বেশী স্হায়ী হয়নি।

নারীকে মানবিক মর্যাদায় দেখার, সমস্ত সৌন্দর্য ও শৌর্য -এর প্রতীক রূপে ভাববার, প্রতিরোধ-প্রতিবাদ-পুণর্নিমান এর প্রেরণা ও সহযাত্রী-তুল্য বিচারের প্রয়াস যা আরবীয় কাব্য-সাহিত্যে বিরল, তা মাহমুদ দারবিশ্-এর কবিতাতে নিবিষ্ট পাঠক মাত্রের দৃষ্টিগোচর হতে বাধ্য। কবি-র কথা-

“We are friends, therefore journey beside me, hand in hand
Together, we make bread and songs
Why do we question this path- for what fate walks with us?
What is the source of our courage?
For it is my sufficiency, and yours, that we journey
Together, for eternity…”

ফিলিস্তিনের গ্রাম থেকে গ্রামে, দেশের প্রত্যন্ত অংশে ঘুরে ঘুরে সান্ধ্য-আসরে বা হাজার হাজার মানুষের জনসমূদ্রে কবিতা পাঠ, জনগনকে স্বদেশ-প্রেম এবং দখলদারিত্বের পরাক্রমশালী শক্তির বিরূদ্ধে প্রতিরোধ-যূদ্ধে উদ্ধুদ্ধ করা ও এক মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখানো, আজন্ম প্রেমিক- পুরুষ ছিলেন কবি মাহমুদ দারবিশ্।দারবিশ্ তাঁর “প্রতিরোধের কবিতা”-য় যাপিত জীবন ও স্বদেশ-স্মৃতিকে তুলে এনেছেন এভাবে:

“I come from there and I have memories
Born as mortals are, I have a mother
And a house with many windows,
I have brothers, friends,
And a prison cell with a cold window.
Mine is the wave, snatched by sea-gulls,
I have my own view,
And an extra blade of grass.
Mine is the moon at the far edge of the words,
And the bounty of birds,
And the immortal olive tree.
I walked this land before the swords
Turned its living body into a laden table.

I come from there. I render the sky unto her mother
When the sky weeps for her mother.
And I weep to make myself known
To a returning cloud.

I learnt all the words worthy of the court of blood
So that I could break the rule..
I learnt all the words and broke them up
To make a single word : Homeland…”

তাঁর কবিতার মতোই, জীবন-সানিধ্যে আসা রমণীগণও যেন সহজাত, সন্মোহক, চিরকালের আবেদনময়ী নারী সত্ত্বা, দেশ-কাল-পরিপার্শ্বের সীমানা পেরিয়ে!


পাহাড়ী ভট্টাচার্য : কবি ও চিন্তক। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন