নারী শিক্ষা বিষয়ক বেগম রোকেয়া’র নিবন্ধঃ
খোদা দেয়, পুরুষ কেড়ে নেয়
মূলঃ বেগম রোকেয়া, অনুবাদ : আলমগীর মোহাম্মদ।। পুবাকাশ
প্রবাদ আছে,” মানুষ যা চায়, খোদা তার বিপরীত ঘটায়। ” কিন্তু আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি খোদা দেয়, আর পুরুষ কেড়ে নেয়। বস্তুত, খোদা তাঁর সৃষ্টি নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য করেননি। বাঁচার জন্য খাদ্য, পানাহার, ঘুম ইত্যাদি মানবজীবনে প্রয়োজনীয় জিনিসের খোঁজ করার জন্য উভয়েই বাধ্য। ইসলাম আরো শিক্ষা দেয় যে নারী ও পুরুষ উভয়ই খোদার ইবাদাত করতে সমান দায়বদ্ধ।
আমাদের প্রিয় নবী বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন ফরয।” কিন্তু আমাদের ভাইয়েরা শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ন্যায্য অধিকার দেবে না। প্রায় ষাট বছর আগে তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি পুরুষের ক্ষেত্রেও। এবং এখন তাঁরা সেই ভুলের খেসারত দিচ্ছে। ভারতে সম্পদ,স্বাস্থ্য, এবং প্রজ্ঞার সকল দরোজা মুসলমানদের জন্য বন্ধ। কারণ হিসেবে বলা হয় তাঁরা যোগ্য নয়। মুসলমান পরিচালিত কয়েকটি পত্রিকা এই অভিযোগ অবশ্যই অস্বীকার করবে। কিন্তু অদক্ষতা বা অযোগ্যতার ছাপ আমাদের কপালে লেগে আছে, মুখে ফুটে উঠে । এবং এটাই সত্য। আমাকে এমন কথাও বলার দুঃসাহস করতে হচ্ছে যে, সুশিক্ষিত মায়ের সন্তান অশিক্ষিত বা শিক্ষাবঞ্চিত মায়ের সন্তানের চেয়ে ভালোভাবে বেড়ে উঠে। কথার ছলে মরহুম বেগম শামসুল হুদা প্রায়ই বলতেন, মুসলিম জনতা প্রায়ই তাঁর স্বামীকে গালমন্দ করেন কারণ তিনি মুসলমানদের উপেক্ষা করে উঁচু পদে কয়েকজন হিন্দু ভদ্রলোককে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতে অক্ষম যে তাঁদের ভাইয়েরা সেসব পদের যোগ্য না।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে হিন্দু জনগোষ্ঠী, যারা তাঁদের শাস্ত্রমতে মেয়েদেরকে দশ বছর বা তারও আগে বিয়ে দেওয়ার কথা, তাঁরা মেয়েদেরকে শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করছে। নারীদেরকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিচ্ছে। উল্লেখ্য, তাঁরা শিশুবিবাহ রোধে আইন করার দাবি করছে ধর্মীয় পণ্ডিতদের বাঁধা উপেক্ষা করে। এবং বিধবা বিবাহকে জনপ্রিয় করার জন্য তাঁরা পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে পণ্ডিতদের মতকে থোড়াই পাত্তা দিচ্ছেন তাঁরা । পণ্ডিতরা মত দেন এই বলে যে, “নারীরা শুধু দ্বিতীয় বিবাহ হতে বিরত থাকবে তা নয়, স্বামীর মৃত্যুর পর তারা নিজেদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে ফল,মূল ও ফুল ইত্যাদি খেয়ে দিনাতিপাত করে। ”
অন্যদিকে, ইসলামে যেখানে নারীদের প্রত্যেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, যেমন মতামত ছাড়া কোন মেয়েকে বিবাহ দেয়া যাবে না, শিশুবয়সে বিবাহ যেখানে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, সেই ধর্মের অনুসারীদেরকে দেখা যায় মেয়েদেরকে তাঁদের মতামত যাচাই না করে বা অল্পবয়সে জোরপূর্বক বিয়ে দিতে। অনেক ক্ষেত্রে অল্পবয়সী বালিকাবধূকে দেখা যায় তাঁর অপরিচিত ষাটোর্ধ বুড়ো বা মদ্যপায়ী স্বামী নিয়ে বিলাপ করতে। এবং আমাদের তথাকথিত ভদ্রসমাজ বিধবা বিবাহ ঠেকিয়ে রাখতে পারাকে গর্বের বিষয় মনে করে। বিধবা বধূর বয়স সেই যা হোক বালিকা বা সাত বছরের শিশু।
আমাদের ভাই-ভ্রাতারা সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধটা করেন শিক্ষার অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করে। যেকোনো গরীব মেয়ে, যে পড়ালেখা করতে চায়, তার সামনে সবসময় কোন না কোন এক মুরুব্বি চাচা-দাদা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় সাধারণত মায়েরা মেয়েদেরকে শিক্ষিত করতে চান, কিন্তু বাবা-চাচা প্রমুখের বাঁধার সামনে তাঁরা অসহায়। আমাদের কি উচিত হবে না সেসব বাবা,চাচা বা দাদাদেরকে প্রশ্ন করতে যে কোন অধিকার বলে তাঁরা মেয়েদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে? তাঁরা কি কোরান হাদীসের কোন উদ্বৃতি দিতে পারবেন কি এই অনধিকার চর্চার পক্ষে?
আমরা জানি যে সমাজে কিছু কিছু সচেতন মুসলমান আছেন যারা মেয়েদেরকে ঠিক কোন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাবেন সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভালো একটা হাইস্কুলের অভাবে তাঁদের ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে সিস্টেমকে দায়ী করে তাঁদের আক্ষেপ করতে শোনা যায়। কলকাতার জনগণ কেন মুসলিম মেয়েদের জন্য একটা মানসম্মত হাইস্কুলের ব্যবস্থা করতে পারবে না? কলকাতায় এমন একটি স্কুলের খুব প্রয়োজন যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সন্তানদেরকে হোস্টেল সুবিধাসহ পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে পারবে। আমাদের পক্ষ থেকে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাইস্কুলকে ঠিক সেই ধরনের একটা বিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করার ইচ্ছা পোষণ করছি যদি জনগণ আমাদেরকে প্রয়োজনীয় সাহায্য -সহযোগিতা প্রদান করেন।
বেগম রোকেয়া’র God gives, Man robs নিবন্ধের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন: আলমগীর মোহাম্মদ: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অভ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি।