গল্প
রাজ শকুনের ছায়া ।। রওশান ঋমু।।পুবাকাশ
ঘরের কাছেই মসজিদ, ভেসে আসলো আযানের ধ্বনি। আর দেরি করা যায় না, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বউ বাচ্চাদের হাত ধরে আবছায়া আঁধারে পা রাখলো মহামারীর কবলে পড়া, কালের সাক্ষী কাপড় ব্যবসায়ী রাবেয়ার স্বামী দেলোয়ার হোসেন।
ভাদ্র মাসের কড়া রোদে ডজন খানেক প্যান্ট কাঁধে নিয়ে দেলোয়ার রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে সেগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করছে। ঘামে শার্ট ভিজে পিঠের সঙ্গে লেপ্টে আছে, নাকে মুখে মাস্ক থাকায় অস্বস্তি হচ্ছে ; কপালের ঘাম চুঁইয়ে ওর ভেতর ঢুকে মুখে চলে আসে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাস্ক একটু ফাঁক করে ঘাম মুছে আবার সেটি ঠিক করে পরে নিলো। সদরঘাট লঞ্চঘাটে এসেছে যদি কিছু প্যান্ট বিক্রি করা যায় সেই আশায়। বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করা লোকজন শেষ মুহুর্তে প্রিয়জনের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে চায়। তখন তার দুই-একটা প্যান্ট বিক্রি হয়।
গত তিনদিন একটাও বিক্রি করতে পারেনি।
আজ তার ভাগ্য খুবই ভালো ; চারটা প্যান্ট বিক্রি করে বারোশ টাকা পেয়েছে। মনের মধ্য খুশির রেশ ফুটে উঠেছে । সে তো বেশি কিছু চায়না। কেবল বউ বাচ্চাদের নিয়ে খেয়ে-পরে সন্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। একটু পর আছরের আযান হবে, বিকেল হয়ে গেছে অথচ রোদের মারমুখী তেজ কমেনি। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে মসজিদে ঢুকে ভালো করে ওযু করে নিলো। মুসুল্লীরা এক হাত দূরে দূরে নামাজে দাঁড়িয়েছেন, সে তার প্যান্টের ব্যাগটি সামনে রেখে নামাজে শরীক হলো।
নামাজ শেষে কাঁচা বাজারে ঢুকলো। প্রচুর লোক বাজারে ; কিন্তু গুটি কয়েকের মুখে মাস্ক আছে। অনেকের কানের পাশে ঝুলছে কারো থুতনির নিচে নামানো, কেউ হাতে নিয়ে হাঁটছে। হযবরল অবস্থা। দেলোয়ার ভাবল সে-ও মাস্ক খুলে পকেটে নিয়ে নেবে, পরক্ষণেই মনে হলো তার পরিবারের কথা। সে নিয়ম না মানলে তার পরিবার বিপদে পরতে পারে। যত কষ্টই হোক তাকে নিয়মের ভেতরে থাকতে হবে। তিনদিন হলো ঘরে একদানা শষ্য নেই, যা আয় হয়েছে তার কিছু দিয়ে বাজার করে নিয়ে যেতে হবে। একটা বাজারের ব্যাগ বাসা থেকেই নিয়ে এসেছে, নয়তো নতুন ব্যাগ কিনতে দশ টাকা লাগবে। ব্যাগ হাতে সবজির দোকানে গেলো কিন্তু সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। কয়েকটা দোকান ঘুরে ঘুরে যাচাই করে দেখলো সব দোকানে প্রায় একই দাম, যা তার মত নিম্নবিত্তের সাধ্যের বাইরে। বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথায় কয়েকবার চক্কর দিয়ে দিশাহারা অবস্থা তার। সে কী কিনবে, কিভাবে কিনবে ! একটা ছোট লাউয়ের দামই সত্তর টাকা ! তার পাঁচ জনের সংসারে এ রকম একটা লাউ একবেলায় শেষ হয়ে যাবে। কাঁচা মরিচের কেজি তিনশ টাকা ! কচুমুখী ষাট টাকা ! কপাল বেয়ে চিকন ঘাম পড়ছে, এ ঘাম গরমের ঘাম নয় ; এ ঘাম বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ঘাম। এক কেজি আলু, এক কেজি কচুমুখী, এক ফালি মিষ্টি কুমড়া , আধা কেজি মসুরের ডাল, পাঁচ কেজি মোটা সিদ্ধ চাল, বিশ টাকার শুকনো মরিচ আর এক আঁটি লালশাক কিনলো ।আগে শাকের আঁটি বেশ বড়সর ছিলো। এখন কমে তা অর্ধেক হয়ে গেছে ; অথচ দাম কমেনি, ত্রিশ টাকাই। লাল শাক না কিনলেও চলতো কিন্তু রাবেয়ার পছন্দ লালশাক। রাবেয়া লালশাক ভাতে মেখে লাল ভাত খেতে পছন্দ করে। দেলোয়ার স্ত্রীর আনন্দিত মুখ দেখতে ভালোবাসে। সবজি কেনা শেষ করে মাছের দিকটায় গেলো। যদিও মাছ কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবু একটু দেখতে যাওয়া ; যদি সস্তায় কিছু মেলে! ছেলেটার মাছ ছাড়া ভাত খেতে কষ্ট হয়। প্রতিদিন খেতে বসে মাছ না পেলে কান্না জুড়ে দেয়, রাবেয়া ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়ায় কখনো, কখনো সামলাতে না পেরে মাঝেমধ্যে ছেলের পিঠে দুচার কিল বসিয়ে নিজেও কাঁদতে বসে। ছেলে ওখানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে। পাতে মাছ হলে খুঁটে খুঁটে সবটুকুন ভাত পাখির ছানার মত খেয়ে উঠে যায়।
লোটে মাছে বাজার সয়লাব। দামও আজ আগের চেয়ে কম, আশি টাকা। দেলোয়ার দরদাম করে দেড় কেজি মাছ কেনে দেড়শ টাকায়। অনেক দিন পর ছেলে মেয়েরা খুশি মনে ভাত খাবে। বুকের মধ্যে এক চিলতে খুশির হাওয়া বয়ে যায় ওর। এবার ঘরে ফেরার পালা। ছয় নম্বর পাবকিল বাসে উঠে বসেছে সে। বাসের ভাড়া করোনাকালে দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে দুই সিটে একজন বসবে। কার্যত দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র, ভাড়া দ্বিগুণ এবং যাত্রীও আগের মতো। একজনের গায়ের উপর আরেকজন। দেলোয়ার বসার জায়গা পেয়েছে। ক্লান্তিতে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। ভোর রাতে এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা রেখেছে সে আর রাবেয়া। ঘরে খাওয়ার মতো কিছু না থাকলে সেইদিন রোজা রাখে দুইজন। তিন বাচ্চাকে আধপেটা খাবার দেয় কোনো রকমে, তাও নামমাত্র খাবার ! একমুঠো শুকনো ভাত, একটু কলমী শাক নয়তো আলুসেদ্ধ ভাত। এরচে বেশি কিছু যোগাড় করতে পারেনি সে এই দুইমাসে। কাপড়ের দোকানে যা আয় হতো তা দিয়ে দোকান ভাড়া, বাসা ভাড়া, বাচ্চাদের পড়ার খরচ, খাওয়া খরচ সব সুন্দর ভাবে মিটে যেতো।যদিও সঞ্চয় করা হতো না তেমন। তবু ভালোই চলছিল সংসার। এক অদৃশ্য অণুজীবের আক্রমণে সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখ দেশের সব কিছু লকডাউন হয়ে গেলে তার কাপড়ের দোকানও বন্ধ হয়ে যায়। দুইমাস দোকানের ভাড়া টেনে সে বাধ্য হয়ে দোকান ছেড়ে দেয়। দোকানের সমস্ত কাপড় বাসায় এনে কাঁধে নিয়ে ফেরি করা শুরু করে। কিন্তু করোনার ভয়ে মানুষ ঘর বন্দি, পথঘাট শূন্য। কাপড় বিক্রি হয় না। উত্তোরোত্তর তার অভাব বাড়ে। মৃত্যু আতঙ্কে দিশাহারা মানুষের জীবনে নেমে আসলো অর্থনৈতিক দুরবস্থা।
গনগনে আগুনের আঁচে রাবেয়ার ফর্সা মুখ লালচে হয়ে উঠছে। তেলহীন রুক্ষ চুল না আঁচড়িয়ে খোপা করে রেখেছে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতো টলমলে ঘাম আঁচলে মুছে খুন্তি দিয়ে তাওয়ার উপর রুটি উল্টে দিলো। চার কাপ আটা পাশের বাসার ভাবীর কাছ থেকে ধার এনে তাই দিয়ে দশটা রুটি বানিয়েছে। ইফতার আর রাতের খাবার হয়ে যাবে। আজকে দেলোয়ার চাল আনতে পারবে কি না সে নিশ্চিত নয়। গত দুইদিন কিছুই আনতে পারেনি। সে উপোস করতে পারে কিন্তু বাচ্চা আর দেলোয়ারের জন্য তার কষ্ট হয়। কখনো তো এমন উপোস করতে হয় নি তাদের। দুপুরে শাপলা ভাজি করেছিলো তাই দিয়ে ভাত দিয়েছে । ছেলে মাছ মাছ করে , আবার দুধ ভাতের জন্য কাঁদতে শুরু করলে আদর করে অনেক ভাবে সামলাতে না পেরে রাগে দুঃখে মুখে আঁচলে চেপে নিজেই কাঁদতে লাগলো। মেয়েরা মাথা নীচু করে খেয়ে ভাইকে কোলে নিয়ে আদর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।
ছেলের আশায় পর পর দুই মেয়ের পর এই ছেলে হয়েছে। মেয়েরা ক্লাস টেন এবং এইটে পড়ে কিন্তু ছেলেটা কেবল ক্লাস টু। মহামারী সম্পর্কে মেয়েরা জানে তাই খেতে না পেলেও চুপ থাকে। ছেলেটির বোঝার বয়স না হওয়ায় সে বিভিন্ন বায়না ধরে। সাত রাজার ধন মানিক পেয়েছে সে আর দেলোয়ার। দুঃখ হয় সেই ছেলেকে খেতে দিতে না পারার, তাকে মারার পর রাবেয়ার বুক ফেটে যায়।
অবসর সময়ে পাড়ার মহিলাদের কাপড় সেলাই করে সেও কিছু রোজগার করতো। ইদানীং তারা কেউ তার কাছে আসেনা। পাঁচ মাস হলো সেলাই মেশিনে খটখট শব্দ ওঠেনি। আগে এই শব্দে তার মাথা ব্যথা করতো অথচ এই শব্দের জন্য প্রাণ আকুলিবিকুলি করে এখন। সেলাইয়ের টাকা জমিয়ে আর দেলোয়ারের কাছ থেকে অল্প কিছু নিয়ে গত বছর ফ্রিজ কিনেছিলো। বাচ্চারা বায়না ধরেছিলো দেওয়াল টিভির। সে টিভি কেনার টাকাও প্রায় জমিয়ে ফেলেছিলো, টিভি কেনা হয়নি, সেই টাকা দিয়ে এক মাসের ঘর ভাড়া দিতে হয়েছে। গলায় একটা সরু স্বর্ণের চেইন ছিলো তা বিক্রি করে কিছুদিন চাল ডালের সংস্হান হয়েছে। কিন্তু আর চলছে না। ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে গতমাসের ; এ মাসেরও প্রায় পনেরো দিন চলে গেছে। টাকা যোগাড় হয়নি। গত তিনদিন ধরে নির্জন দুপুরে বাড়ি ওয়ালা আসে তাগাদা দিতে, আজও এসেছে । ধূর্ত শিয়ালের চাহনি ওর চোখে। নোংরা জীভে অশ্লীল আওয়াজ করে বলেছে রাবেয়া চাইলে সব ভাড়া মাফ হয়ে যেতে পারে। দুঃখে অপমানে সে মরমে মরে গেছে। মাথায় আঁচল তুলে দরজার আড়ালে গিয়েও রক্ষা পায়নি সে। বাড়িওয়ালা এসে প্রায় ওর গায়ের সঙ্গে লেগে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির উপর দিয়ে নিজের পুরুষঅঙ্গে হাত বুলাচ্ছে।
কাটা মুরগীর মতো থরথর করে কাঁপছে রাবেয়া,গরম লোহার রড ঢুকিয়ে এফোড় ওফোড় করছে যেন হৃৎপিণ্ড।
হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় লাল চোখ শয়তান। অর্থের কাছে গরীব মানুষ চিরদিন জিম্মি, লালসার মদ গিলে অমানুষের কাতারে সামিল হয় মানুষ।
মাগরিবের একটু আগে আগে দেলোয়ার ফিরেছে বাসায়। খুশি খুশি ভাব নিয়ে বাজারের ব্যাগ রাবেয়ার হাতে দিয়ে গোসলে ঢুকলো। ইফতার সেরে রান্নাঘরে স্ত্রীর পাশে মোড়া নিয়ে বসলো, রাবেয়া পিঁড়িতে উবু হয়ে বসে মাছ কুটছে। যখন সে ঘরে থাকে তখন মাছ বা সবজি কাটার সময় রাবেয়ার পাশে গিয়ে ওকে একটু সহযোগিতা করে। রাবেয়া অবশ্য এতে আপত্তি করে ; সে চায়না সারাদিন বাইরে খেটেখুটে এসে আবার বাসার কাজে দেলোয়ার হাত লাগাক। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার ওর ; কিন্তু দেলোয়ার হাসিমুখে সেই কথা উড়িয়ে দিয়ে ওর পাশেই গিয়ে বসে। লালশাকের গোড়া ফেলে ঝুড়িতে রাখতে রাখতে আজকের ভাগ্যের কথা বলছে দেলোয়ার। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর খেয়াল হলো রাবেয়া তেমন কিছু বলছে না। মাথা নীচু করে মাছ কুটে যাচ্ছে। চিন্তিত চোখে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে , থমথমে মুখ যেন ঝড়ে উপড়ে গেছে গাছ শেকড় ছিঁড়ে, কী টকটকে ফর্সা রঙ ছিলো ওর ; এখন কেমন কালচে, ভীষণ ক্লান্ত দেখায়, নিষ্প্রাণ মানুষ যেন। দেলোয়ারের বুকের ভেতরটা কষ্টে মুচড়ে উঠলো। খুশির রেশ আচমকা কেটে গিয়ে সেখানে ভর করেছে দুশ্চিন্তা। যে চিন্তা প্রতিক্ষণ প্রতিদিনের, বেঁচে থাকার চিন্তা, বাঁচিয়ে রাখার চিন্তা। সে জানে না আগামী দিনগুলি কিভাবে কাটবে, আদৌ কাটবে কি না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে । রাবেয়া চমকে দেলোয়ারের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হতেই অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে, প্রাণপনে লুকোতে চায় ওর ভেতরের যন্ত্রনা। দেলোয়ার সংসার চালানোর চিন্তায় বিপর্যস্ত, তার উপর আরো চিন্তা তাকে দিতে চায় না। কিন্তু প্রেমিক স্বামীর চোখ ফাঁকি দেওয়া রাবেয়ার সাধ্যের বাইরে। শাক কোটা রেখে রাবেয়ার দিকে গভীরভাবে তাকায় সে।
রাবেয়ার গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে, আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ; ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো । দেলোয়ারের বুক কেঁপে উঠলো, আকুল হয়ে জানতে চাইলো কান্নার কারণ। রাবেয়া কিছু না বলে বসা হতে উঠে হাত ধুয়ে ছুটে চলে যায় শোবার ঘরে, পিছু পিছু দেলোয়ার। রাবেয়া বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ ঢেকে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। দরজা বন্ধ করে রাবেয়ার পাশে বসে পিঠে হাত রাখে সে। স্ত্রীকে কিছু সময় কাঁদতে দিয়ে আস্তে আস্তে পিঠে -মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে রাবেয়া। এইবার দেলোয়ার দুই হাত দিয়ে স্ত্রীর মুখ নিজের মুখের কাছে এনে কান্নার কারণ জানতে চায়।
রাবেয়া স্বামীর বুকে মাথা রেখে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। দেলোয়ার বুঝতে পারে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। রাবেয়া খুব শক্ত ধাতুতে গড়া, ছোটখাটো বিষয় সে কখনো দেলোয়ারের সামনে মেলে ধরে না ; নিজেই তার সমাধান করে। আজকের এই অবাধ্য কান্নার দৃশ্য দেলোয়ারের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া দেলোয়ারের বাহু বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে পাশাপাশি বসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় দুপুরে বাড়িওয়ালার লোভের খড়্গ তার হৃৎপিন্ড কিভাবে কেটে কুচিকুচি করেছে সেই বর্ণনা দিলো। কথাগুলো গনগনে গলিত লোহার মতো দেলোয়ারের কানে ঢুকলো। অক্ষম আক্রোশে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো সে। মনুষ্যত্বের নির্দয় অসুখের মহাউৎবস শুরু হয়েছে পৃথিবী ব্যাপী। বাতাসে হাহাকারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাবেয়া রান্না ঘরে গিয়ে রান্নার কাজ কোনমতে শেষ করলো। অনেক দিন পর আজ ঠিকমতো রান্না হয়েছে ঘরে, বাচ্চারা তৃপ্তিসহ খেয়ে উঠে গেলো আগে। দেলোয়ার এবং রাবেয়া খেতে বসেছে। রাবেয়া প্লেটে ভাত বেড়ে এগিয়ে দিলো স্বামীর দিকে। সারাদিনের অভুক্ত দেলোয়ারের ভাতের গন্ধে তেমন কোনো বিকার হলোনা। নিরাসক্ত চোখে একবার ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা একবার রাবেয়ার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। নিজেকে এতো অসহায় কখনো লাগেনি ওর, গলা দিয়ে ভাত নামছে না কিছুতেই। নিজেকে এতো তুচ্ছ, এতো অপদার্থ মনে হয় নি কখনো। অসহায় সে, কি করে স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। কার কাছে গিয়ে সহযোগিতা চাইবে, এই মহামারীকালে তার মতো অবস্থা তার পরিচিতজনদের ; আর্থিক সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। তার সামনে কোন পথ খোলা নেই। রুটি রুজির জন্য তাকে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকতে হয়, স্ত্রী একা, মেয়েরাও বড় হয়েছে ; যে কোনো সময় বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে। তখন আত্নঘাতী হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। অসংখ্য চিন্তা মাথায় জট পাকিয়ে তাকে খেতে দিলো না।
প্রায় পাঁচ দিন অভুক্ত সে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভীষণ ভরা পেট ; একটু খেলেই বমি হয়ে যাবে।
ওদিকে মাথা নিচু করে রাবেয়া ভাত মাখছে, দু একবার মুখেও তুলছে কিন্তু দেলোয়ার বুঝতে পারছে ভেতর কতটা ক্ষরণে সে রক্তাক্ত হয়ে আছে। দেলোয়ার খাওয়া ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। বাইরে নিকষ অন্ধকার, তার জীবনের মতো। এক বিন্দু আলোর রেখা কোথাও নেই কেবল তার চোখ জুড়ে আগুন জ্বলছে ; সে আগুন ঘৃণার,সে আগুন অপমানের, সে আগুন হাড় হাভাতের প্রতিশোধের আগুন।
দুটি শোবার ঘরের একটিতে দুই মেয়ে অন্যটিতে ছেলেকে নিয়ে থাকে দেলোয়ার। ওদের দু জনের মাঝখানে ছেলে গুটিসুটি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাত কতো হয়েছে বুঝতে পারছে না দেলোয়ার, মানসিক বিপর্যয় এবং অভুক্ত রাবেয়া অচিরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ দেলায়ার শুনতে পায়। কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে সে, উথালপাথাল চিন্তা তার মন জুড়ে। শোয়া হতে উঠে নিঃশব্দে ছেলেকে পাঁজাকোলা করে নিজের জায়গায় শুইয়ে সে মাঝখানে এসে রাবেয়ার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। চিৎ হয়ে শোয়াতে নিঃশ্বাসের সঙ্গে রাবেয়ার বুক উঠা নামা করছে , দেলোয়ার ভার না দিয়ে ডান হাতটা রাবেয়ার বুকের উপর রাখলো। অনুভব করলো আগের মতো সুঠাম নেই রাবেয়ার স্তন, কেমন যেন থলথলে হয়ে আছে ; পাঁজরের হাড় বের হয়ে রোগা হয়ে গেছে খেতে না পেয়ে। হঠাৎ কষ্টে দেলোয়ারের চোখে পানি চলে এলো, গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে, চোখ না মুছে আস্তে আস্তে রাবেয়ার বুকে হাত বুলাতে লাগলো। এই প্রথম সে কোন কাম অনুভব করলো না শুধু আদর করতে লাগলো। ছোট বাচ্চাকে যেমন মা পিঠে বুকে আদর করে ঘুম পাড়ায় তেমনি।দেলোয়ার বুঝতে পেরেছে রাবেয়ার ঘুম ভেঙ্গেছে, চুপচাপ শুয়ে আছে কথা না বলে। দুটি মানুষ একে অন্যের খুব কাছাকাছি যেতে কোন কথার দরকার হয়না, হৃদয়ের কথা শুনতে হৃদয় থাকতে হয়। রাবেয়া কাৎ হয়ে স্বামীর কোমর জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর মুখ গুঁজে ব্লাউজের হুক খুলতে গেলে দেলোয়ার রাবেয়ার হাত ধরে আলতো চাপ দেয়, না আজ নয় রাবু। আরো ঘন হয়ে মুখের কাছে মুখ এনে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে অনেকক্ষণ। তারপর রাবেয়াকে ঘুমুতে বলে সেও চোখ বন্ধ করে। রাবেয়া ঘুমিয়ে পড়ে নিমেষে অথচ তার ঘুম আসে না। মাথার ভেতর অস্থির লাগে, কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করে, পানির পিপাসায় বুক ধড়ফড় করে। নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে পরপর দু’গ্লাস পানি খায়। ধীর পায়ে বারান্দায় এসে সিগারেট জ্বালায়, প্রতি টানে অন্ধকারে জোনাকি জ্বলে যেন, সেই সাথে তার বুক পুড়ে খাক। এই বাসাটা একতলা, বারান্দায় টবে শিউলি গাছ লাগিয়েছে রাবেয়া। ফুলে ফুলে শাদা হয়ে আছে গাছ, চারদিকে হালকা মিষ্টি ঘ্রাণে সয়লাব। গ্রীলে হাত রেখে ফুলের দিকে তাকায় , উথালপাতাল চিন্তা তার মাথা জুড়ে। বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো মাথায় খেলে গেলো এক চিন্তা। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে রাবেয়াকে ঘুম হতে তুলে জানালো তাদের এখনই বের হতে হবে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। হতচকিত রাবেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে
মৃদু হেসে জানালো অনেক দিন দেশের বাড়ি যাওয়া হয়না চল বাড়ি যাই, আজকে সকাল ছয়টায় একটা লঞ্চ আছে, আর ফিরে আসবো না। দেশে জমি যা আছে তাতেই চাষবাস করবো। বাচ্চাদের তুলে কাপড় পরে নিতে বলে তাড়াতাড়ি যা পারলো টুকটাক গুছিয়ে নিলো দুইজনে। ভোর হয় হয়, একটু পরেই আযান হবে, অন্ধকার কেটে ফরসা হয়ে উঠবে, চারপাশে মানুষজন জেগে উঠবে। তার আগেই এই ঘর এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। বের হওয়ার সময় ফ্রিজের গায়ে মমতার হাত রেখে জলভরা চোখে ঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র, প্রতিটা কোণের দিকে বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে দেখছে সে। কতো দিন কতো রাতের আনন্দ বেদনার সাক্ষী ওরা। আত্নসন্মানের ভয়ে ওদের ফেলে পালাতে হচ্ছে চোরের মতো। তবে এক দিকের স্বান্তনা হলো ওরা বাড়িওয়ালাকে ঠকায়নি, ঘরের জিনিস বিক্রি করে বাড়ি ভাড়ার টাকা উঠে যাবে। কিন্তু এরপর কিভাবে চলবে, বাড়িওয়ালা তাকে গিলে খাবে হাঙ্গরের মতো। ঘরের কাছেই মসজিদ, ভেসে আসলো আযানের ধ্বনি। আর দেরি করা যায় না, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বউ বাচ্চাদের হাত ধরে আবছায়া আঁধারে পা রাখলো মহামারীর কবলে পড়া, কালের সাক্ষী কাপড় ব্যবসায়ী রাবেয়ার স্বামী দেলোয়ার হোসেন।
রওশান ঋমু: কবি ও কথাশিল্পী। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘফুল ও যৌথযন্ত্রণা, কুয়াশার কয়েদ।
এ যেনো গল্প নয় ; দুঃখী যাপনের যথার্থ চিত্রটি ভীষণ বোধ হতে ভেসে আসা। খুব মনটানা গল্পটি নির্বাচনের জন্যে ‘পুবাকাশ’ সাহিত্যপাতাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। লেখকের প্রতি শুভেচ্ছা।
এ যেনো গল্প নয় ; দুঃখী মানুষদের যাপনকথা ভীষণ সুন্দর বর্ণনে। এমন এই অরুপ গল্পটি নির্বাচনের জন্যে ‘পুবাকাশ’ সাহিত্যপাতাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। লেখকের প্রতি শুভেচ্ছা।
অরুপ লেখন। খুক ভালো লাগলো আমি পাঠকের। পুবাকাশের এই পথচলাকে অভিনন্দন। লেখকের জন্যে শুভেচ্ছা।