স্মৃতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে আমাদের প্রত্যাশা।। আলমগীর মোহাম্মদ।। পুবাকাশ
৫৪ পেরিয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। জোবরার কোল ঘেঁষে বসত গড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম খেয়াল করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশালতা। সরলতার দিনে বিশালতার উপমা হয়ে যেন এসেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনে। ভর্তির আগে কোনদিন যাওয়ার সুযোগ হয়নি। দেখা হয়নি কোন বড় ভাইয়ের সাথে। যদিও এখন আমার সব আড্ডা, সখ্যতা অনেকটা বড় ভাই কেন্দ্রিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এসে রেজাল্ট পেয়ে অনেকটা রিলাক্সড মুডে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম হাটহাজারী কলেজ কেন্দ্রে। রাত বারোটার দিকে রেজাল্ট হলো। পেয়েছিলাম ৭৪! টিকে গেলাম আরকি। খুশি বাঁধভাঙ্গা। বাড়িতে বলে দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ দিবে না। তাই মনে মনে বললাম নিজের শহরে থাকব, চালাতে পারব নিজেকে। ভর্তি হয়েই বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নেয়া বন্ধ করে দিলাম। এভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো শুরু।
সে সময় কলা ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন বিল্লাহ স্যার৷ আর চেয়ারম্যান চৌধুরী স্যার। চৌধুরী স্যার ছিলেন একমাত্র নাম জানা শিক্ষক। আমাদের এক চাচা স্যারের বন্ধু। সেই সুবাদে। কাকা স্যারকে ফোন করে বলেছিলেন আমার কথা। ভাইবা দিয়ে ইংরেজি বিভগে ভর্তি হয়ে গেলাম। ইংরেজি ছিল আমার প্রিয় বিষয়। সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়েছিল।
ভর্তির পর প্রথম দিকে তাল ধরতে না পেরে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম হওয়ার পর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলাম। এরপর মোটামুটি দেরি করে বিভাগ থেকে বের হলাম। সরলে, গরলে পার হয়ে গেল সাত বছর দশ মাস। এই সময়েই আমার বেড়ে উঠা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় ছিল একটা বিল্ডাংসরোমান আর আমি হলাম সেটার সেন্ট্রাল কারেক্টার।
ইংরেজি বিভাগ আমার চোখ খুলে দিয়েছে। জীবনের জটিল বাঁকগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়ে। সম্মানিত শিক্ষকদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক সেশনজটে হারানো দুই বছর দশ মাসের কথা কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দেয়। তারপরেও অপ্রাপ্তির আক্ষেপ রয়ে যায়। অবশ্যই আক্ষেপে লাভ নেই। গানে আছে না, “কান্নায় লাভ নেই। কান্নায় হবে না কোনদিন মেঘনা যমুনা… ” তাই আক্ষেপ ভুলে এগোতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে আমার সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিভাগে আমাদের সময়ে কর্মরত সকল ককর্মকর্তা -কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সম্পূর্ণ পাড়া গাঁ থেকে আসা অজ্ঞাতকুলশীল আমিকে একটা পরিচয় করে দিয়েছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজঘেরা বিশাল মাঠ, এক চোখের পথ কলা ফ্যাকাল্টি, চিরায়ত আড্ডাস্থল ঝুঁপড়ি, প্রতিভা বিকাশ ও বিনাশের অন্যতম বাহন শাটলে আজো আটকে আছে আমাদের আবেগ। একশো বিশ-এ ঠান্ডায় জমে যাওয়ার পরেও ক্লাসে অংশগ্রহণ করা, দোতলার ক্লাসে জানালা দিয়ে র্যাগ ডে’র বীণ শোনা, ফ্যাকাল্টির করিডোরে স্বাধীনভাবে হাঁটা সবই মিস করি। শেষের দিকে শাটলে যখন শুনতাম, ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো যায় যায়… হারিয়ে যায়… উজ্জ্বল স্বর্ণালি দিনগুলো হায় হারিয়ে যায় যায়…”। শুনে চোখের কোণে জলরেখা দেখা দিতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেশনজটের কারণে। আর এখন সংকীর্ণতার দেয়ালে যখনই আটকে পড়ি তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা মাঠ, সবুজবীথি, কলার ঝুঁপড়ি, বিবিএর সামনের কৃষ্ণাচূড়ার লাল মূর্তি, স্টেশনে মামুর দোকানের নাস্তার কথা মনে করে আফসোস করি। সাগর থেকে বেরিয়ে কুয়ায় আটকে পড়া জীবন এখন যেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মদিবসে প্রত্যাশা করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এগিয়ে যাক।সেশনজট দূর হোক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসন নিশ্চিত হোক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবেগের অন্যতম বাহন শাটলের উন্নয়ন হোক, শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের জন্য ভালোমানের বাস দেয়া হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকে নিয়মিত বইপুস্তক, গবেষণাপত্র প্রকাশ হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সলেশন সেন্টার চালু হোক এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করুক।
মোহাম্মদ আলমগীর।। শিক্ষক ও অনুবাদক।। প্রাক্তন শিক্ষার্থী।। ৪৫ তম ব্যাচ ।। ইংরেজি বিভাগ।