গুচ্ছ কবিতা।। রওশন রুবী।। পুবাকাশ
১. আমরা কেউ আর কারো জন্য জ্বলে উঠি না
এখন আর কেউ আমরা কারো জন্য জ্বলে উঠি না।
একদিন আমরা পুড়তে থাকা আমাজান হয়েছিলাম।
আমাদের ভেতর ছিল না মৃত্যুর ব্যবধান,
ছিল হরিণের আর্তনাদ, হিংস্র প্রাণিদের আকুতি আর সবুজ পোড়াগন্ধ। ওসব মেখে তুলেছিলাম শ্বাস।
আমাদের চিবুক থেকে চিবুকের ঘ্রাণ দূরত্ব হারিয়েছে ,
আমরা আমাদের ধ্যানে বিভোর হয়ে হয়েছি আমাজান।
আরো একবার আমরা বাংলাদেশ হয়েছিলাম।
তখন উনিশশো একাত্তর। দাউ দাউ জ্বলছিল চতুর্পাশ। ঘর-বাড়ি, পশু-পাখি, সর্বোপরি মানুষ পুড়ে পুড়ে
ধোঁয়ার ধূসর। আহ্! কি ভীষণ বিষয়ী সময়!
আহ্! পরান জুড়ে শুধু নখরের ক্ষত লেহন করা বাতাস!
আমরা হয়েছি একেকটা জলদিঘীকাব্য যেমন।
আমাদের বেদ, গীতা, বাইবেল, কুরআন তখন ছাই;
আমাদের প্রার্থনালয়ে ভক্তের মুখরিত পদচারনা নেই,
আমাদের ধর্ম তখন মাকে রক্ষার জন্য ইন্দ্রিয়ের টান।
আমরা ছুটেছি নিজের মত স্বাধীনতার উত্তাল নেশায়,
ছুটেছি সমস্ত প্রেমকে একবিন্দুতে ধাবিত করে;
উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ,পশ্চিমে শত্রু ক্রুর হাসি রণ-ডঙ্কা,
রক্ত আর দর্পিত বুলেট মাখামাখি নির্ভুল গ্রহণকাল।
তারপর! তারপর, আমরা কেউ আর জ্বলে উঠিনি।
আমাদের ভেতরে এখন মৃতসাগরের ঢেউ গুমরে উঠে;
আমরা যেন একে অন্যের জন্য হয়ে উঠেছি পর্যটক।
অপেক্ষার কাঁটা এখন আ-র আগুন চেনে না;
বোতামের বেতালমোহ তৃষ্ণা বোঝে না;
ধুলোওড়া শহরের ফোঁপানি জলদস্যু হয়ে ওঠে না;
বুঝি না কেউই আর ঘর নয় চিত্রের কারিগর।
২. বুননের দহন
ধান দূর্বা মাড়াতে মাড়াতে ভেবেছি ঘাস হয়ে যাবো
জন্মজন্মান্তর রক্তমাংসের গন্ধে বিভোর হবো
পথিকেরা হলুদ বিকেল ছুঁয়ে ছুটে গেলে
হাওয়ার কল্লোল, গান মোড়ানো সময় হবো,
নিরন্নের থালায় ভরে থাকবো অন্নরোদ
রোদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে অভাবের ডাহুক চলে যাবে দূরে।
মানুষের ক্রন্দন এসে হানা দিলে কপাটে কপাটে
বোধ আর বিশ্বাসে জেগে উঠে সৃষ্টির তাড়না
উন্মাতাল লোভে লুফে নেই সবক’টা পেরেক
অবসর খুঁটে নেয় ধ্বনির ব্যঞ্জন;
পাহাড় ভাঙলাম, নদী সাঁতরালাম,
সমুদ্র অবগাহন করে অতঃপর বুঝলাম
ইচ্ছে ক্রমেই বদলে নেয় রূপরেখা,
আয়ত্ব করে নিয়েছে আমাকেও বুননের দহন।
৩. সমাধি
এখন তোমার চোখের উপর থমকে আছে নদী
গল্পগুলো পরান কাঁপায় ভাসতে দিতাম যদি।
হয়তো ভেসে তার ছায়াটা থাকতো নদীর জলে
মুগ্ধ বিভোর মগ্ন আপন ঢেউয়ের ছলে ছলে।
দেখছি ছুটে যাচ্ছে খরা মরছে বেবাক নদী
তোমার চোখের জলেই হবে আমার সমাধি।
৪. মৃৎময় মানবিক বোধ
একদিন মখমল হয়ে উঠবে এই সব মাটি,
আর মখমলে ছড়াবে পুরাণ দিনের মতো
শিল্পীরা তাঁদের গোপন বিলাস।
আমি কৈশোরের সেই আমাকে নিয়ে
আল ধরে হেঁটে যাবো
মৃৎপাড়ায় শিল্পীরা স্বপ্ন পোড়ালে যে
মেঠো গন্ধটুকু উঠে আসে তা শুঁকে নিতে।
আহ্!পরান পোড়া দগদগে ক্ষত
আহ্! সারি সারি স্বপ্নের টেরাকোটা
এই জীবন রেখে কৈশোরে মৃৎপাড়ার
বাসিন্দা হতে চেয়েছিলাম,
হতে চেয়েছিলাম মৃৎশিল্পীর ঘামার্ত
কাদায় মাখা শত কষ্ট লেহন করা মুখ,
তাই তো পালিয়ে ছুঁতে চেয়েছি মৃৎপাড়া,
মুগ্ধতা রেখে গেছি শাঁখা সিঁদুর রমণীদের কোমল মনে।
পারিনি কখনোই কি ভীষণ যন্ত্রণা
রোজ রোজ প্রতিহত করে এটুকু বলতে,
বলতে চেয়েও থমকে গেছি
মাটি মেখে বেঁচে থাকার মধ্যে যে সুখ
সে আমার অট্টালিকায় মেলেনি।
তাই স্বপ্নের আবাস ভূমি বড় ফাঁকা,
এই ফাঁকা আবাস দেখলেই
বাসনারা ফালি ফলি করে সব অবসর,খন্ডিত হয় পৌরানিক ইচ্ছের মতো ইচ্ছের তৈজসপত্র।
আজও পুব আকাশে
সোনালি আলো বিচ্যুরিত হলে
ছুটে যাবার টানে মনটা খাঁ খাঁ করে,
ইচ্ছ করে ভোঁকাট্টা ঘুড়ি হয়ে
আমার সেই মোহন শাঁখা পলার শব্দ গহনে
বেঁচে থাকা প্রতিটি প্রাপ্তির মতো
কন্টকহীন শিল্পগুলো ছুঁয়ে আসি,
ছুঁয়ে আসি সরল মানুষের আদল ।
ইচ্ছে সিঁড়ির যে ধাপগুলো কিছুদিন আগেও
বরষায় ছিলো টলটলে,
কারো পদধ্বনি শুনবার তীব্রতা ছিলো
ওমরের তলোয়ারের মতো সুতীক্ষ্ণ,
অনর্গল উঠে আসা সেই সিঁড়ি ছুঁলে মনে হয়
এই পথটুকু পেরুলেই মৃৎশিল্পীদের ক্ষীণ আলো ঘর।
শুধু এক ছুট ,শুধুই এক ছুট, তারপর আমি ফের
এক মুঠো কাদা থেকে জন্মানো মানব।
আমার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ
অবগুন্ঠন, কঠিন বলয় সব তছনছ,
আর সব শিল্পকর্মগুলো শত শত বছর
পুরানো ময়নামতির গহিন থেকে তুলে আনা
ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিকৃত অথচ অমূল্য সম্পদ ।
৫. সুলক্ষণা
সুলক্ষণা কোথায় থাকে বৃষ্টি বলো; কোথায় মেঘের বাড়ি
বৃষ্টি ধুয়ে দুঃখ নেবো; নেবোই দেখো মেঘের বাড়াবাড়ি,
আমি যে সেই জেনে ছিলাম দাঁড়াও তুমি কালোমেঘের পর
আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র মাসে জলের ছলে কাঁপাও থরোথর।
সুলক্ষণা নাওনি কেন গোলাপ বকুল চাইছো মেঘ আর বারি
বলছি শোন ছোট্ট থেকেই মেঘ চিনি না কোথায় পাবো বারি ।
মেঘ কি তোমার চোখের মনি মেঘ কি খুবই কালো?
পাহাড় বেয়ে নামে যেমন রোজ বিহানে কাজল পরা আলো?
সুলক্ষণা বললে নাকো;দেখলে নাকো; ভাঙছো পথের পথ
ক্লান্তি ধুয়ে নিতেই দেখো ছায়া হয়ে আছে তোমার পেছনে অশ্বথ ।
৬. এপারে জল ওপারে অনল
-ভালো না বাসলে পোড়ে না মানুষ। পুড়ছো কেন বলতো অরুণ?
-কে বললো কাব্য, পুড়ছি আমি? দেখ কী ধবধবে যুবতী রোদ। চলে যাচ্ছে বিকেলের উৎসব কোলে। রাত থেমে আছে দৃষ্টির উৎসে।
-তবে কি তুমি অরণ্য ভালোবেসে দূরে ঠেলে রাখো ঘাস? আর রাখতে রাখতে মেতে উঠো আলোতে মাতাল?
– কেন বলবো তোমাকে অরণ্য আর ঘাসের কথা? অরণ্য আমার গভীরতা, ঘাস পাঁজরের পেলবতা। ও-ও-স-ব তুমি বুঝবে না। বাদ দাও…
-এমন কঠিন কি! বললেই আমি সাঁতরে যাবো অনায়াসে তেরোশত নদী। বললেই আমি ছুঁয়ে দেবো হিমালয়, কৈলাশ আর ভূমধ্যসাগরের ঢেউ।
-আমাকে খননে এসো না। ভাঙনের শব্দ পৃথিবীর গহীনে প্রবেশের মতো রোমাঞ্চকর এবং ভীষণ স্পর্কশাতর। শুধুই পরাভূত হবে।
-জানতে পারিনি কখন, কেন বেয়ে চলে গেছো মানুষের দূর। কেন অনুভব বুকে নিয়ে কুয়াশার জন্ম দাও?
-মানুষ বড্ড অভাগা কাব্য। । যা পায় না তাকে পেতে উন্মাতাল। যা পেয়েছে তাকে কে মগ্নতায় ধরে রাখে বল?
-নিজের সাথে কখনো যখন কেউ প্রতারণা করে, তখন
অক্ষয় কর্মের দিকে ধাবিত হতে পারে না সে। পারে না অকৃত্রিম মানুষ হয়ে উঠতে।
-পারে না বলেই আড়াল করে ভেতরে ভেতরের শ্রেষ্ঠত্ব।
– আচ্ছা এটুকু বলো, তুমি কি উত্তাল পারাবার বহনে নূব্জ্য হয়ে কুড়াতে চাওনি ঘাসফুল?
-না চাইনি।
-তুমি কি অরণ্যের জন্য ব্যবচ্ছেদ করনি পথের নির্জনতা? শ্লোগানে মুখর হয়ে যাওনি দূর থেকে দূরে?
-না যাইনি।
– অরণ্যকে ভালোবেসে লোপাট করনি হৃদয়ের ধার-দেনা?
-না করিনি।
– তারপর তুমি মেঘের হাত ধরে যাওনি গৌধূলির ক্রিয়া দেখতে?
– না যাইনি।
-তুমি কি কাঠঠোকরার ঠোঁটকে অস্ত্র করে খোঁড়নি এ হৃদয়
– না! না! না! না!
-মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে অরুণ! তুমি কি চাও না ধরিত্রি মোহে খণ্ডিত হোক? চূর্ণ হোক মিত্থের চুঁড়া?
-তোমার ইচ্ছে যেমন ভাবো কাব্য। ইচ্ছের বুকে কে দিতে পারে বাঁধ? কে ফেরাতে পেরেছে বিপরীত টান?
-যদি দেওয়া যেত তবে “এপারে জল ওপারে অনল” কী নিতে বলতো দেখি, কি নিতে তুমি?
-অনলে তৃষ্ণা আমার। পুড়েছে কৃষ্ণগহ্বর। জলে আছে অপার ঘোর। এপার ওপার পৃথক করা আমার কম্ম নয়। রুগ্ন আমার বুকে কাঁটার আসর। তুলতে এসো না, তুমি তুলতে এসো না।
-তবে তাই হোক যা তুমি চাও। বিদায়ে বহন করি অমরত্ব। যদি ক্লান্ত হয়ে পড় কখনো, যদি একটুকরো রোদ চাই স্যাঁতস্যাঁতে সময়ের উত্তাপে। তবে এসো। এ হাত সর্বাগ্রে বাড়িয়ে রাখবে স্বাগত বাণী।
রওশন রুবী : জন্ম: ৩১ মার্চ ১৯৭৯, বাবা: এ.কে আহম্মদ উল্যাহ , মা: মোবাশ্বরা আহম্মদ, শিক্ষা: স্নাতক,পেশা: শিক্ষক
কাব্যগ্রন্থ: একদিন মেঘ ছুঁবো একদিন নদী (২০০২), মগ্ন প্রকৃতির চেনা উঠোন (২০১৬ ),কংক্রিটে শামুকের অবয়ব ( ২০১৭) ছেঁড়া পৃষ্ঠা (২০১৯),কেউ থাকে না একলা হাওয়া (২০২০) গল্পগ্রন্থ: বিষণ্ণ ভিটে ( ২০১৮), যদি ( ২০১৮), সরলা(২০১৯) উপন্যাস: শূন্যতার নন্দিত আসমান (২০১৯),কোথাও মেঘ নেই(২০১৯),অকথিত কথার ডায়েরি(২০১৯) কিশোর গল্পগ্রন্থ: হাত (২০২০) স্বীকৃতি: ১.আন্তর্জগৎ পুরস্কার ১৯৯৯, রবীন্দ্রভবন, আরামবাগ, হুগলি, কলকাতা। ২. ২০০০ সালে অভিযাত্রীক, রংপুর, দেশব্যাপী সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার । ৩. ২০০১ সালে অভিযাত্রীক, রংপুর থেকে শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে “স্বর্ণপদক” পুরস্কার । ৪. ২০১৭ সালে লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ, লক্ষ্মীপুর থেকে “জেলার বর্ষসেরা কবি” পুরস্কার। সম্পাদনা: ত্রৈমাসিক “স্বপ্নীল অনুভব,” লক্ষ্মীপুর ।”প্রগতি” সাহিত্য পত্রিকা, লক্ষ্মীপুর । সংগঠনে সম্পৃক্ততা: সাধারণ সম্পাদক, প্রগতি সাহিত্য সংগঠন,লক্ষ্মীপুর । সহ: সম্পাদক পত্রিকা, বাংলাদেশ কবিতা পরিষদ, জেলা কমিটি,লক্ষ্মীপুর ।