জগতের অনেক কিছুই আমার জ্ঞানগম্যের
বাইরে রয়ে গেলো: সিদ্দিক আহমেদ
সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সিদ্দিক আহমেদ জন্ম নেন ১৯৪৬ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের রাউজান থানাধীন গশ্চি গ্রামে। বাবা খলিলুর রহমান মাতব্বর আর মা গুলচেহের। বেড়ে উঠেছেন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে, যাত্রাপালা, গাজির গান, পুঁথি পাঠের আসর আর কবি গানের আসর দেখতে দেখতে। পরিবারেও চলত সাহিত্য-সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চা। ছোটবেলা থেকেই তাই সৃজন ও মননশীল কাজের প্রতি ছিলো তাঁর গভীর ঝোঁক। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে, পাশাপাশি শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা। এখনো তিনি সিদ্দিক মাস্টার নামেই অধিক পরিচিত গশ্চি গ্রামে। জীবনের দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতা পেশার সাথে। বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে তাঁর ছিলো বিশেষ ভূমিকা। সাহিত্য চর্চা করেছেন গৌরবের সাথে। বিশ্ব সাহিত্য চর্চায় তিনি সকলের অগ্রগামী। অনুবাদের মধ্য দিয়ে সহজ করে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ। রচনা করেছেন নয়টি গ্রন্থ। পেয়েছেন অনেকগুলো সম্মাননা, পুরস্কাকার। তাঁর জীবন ও কর্মেরর উপর প্রকাশিত হয়েছে সম্মাননাগ্রন্থও। এছাড়াও তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ- নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার। দীর্ঘ দিন তিনি মরণব্যাধি কর্কট রোগে ভুগে গত ১২ এপ্রিল, বুধবার সন্ধ্যে ছ’টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে যান আর না ফেরার দেশে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন খোলামেলাভাবে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তরুণ কথাশিল্পী আহমেদ মনসুর।
আহমেদ মনসুরঃ আপনার শৈশবের কথা শুনতে চাই।
সিদ্দিক আহমেদঃ আমার ছেলেবেলা অন্য সবার মতই। কোন বিশেষ কিছু নেই। আমার জন্ম হয়েছিলো একটা অর্থ বিত্ত পরিবারেই। আমাদের বাড়ির বেশ সুনাম ছিলো। আমার গ্রামের নাম গচ্ছি। মাতব্বর বাড়ি। দক্ষিণ রাউজানে এটা একটা বিখ্যাত বাড়ি। বাড়ির মাতব্বর যিনি ছিলেন উনি আমার জেঠা। উনাকে বাদ দিয়ে গ্রামে কোন শালিস বিচার হতো না। এমনকি দেখা গেছে যে, দক্ষিণ রাউজানে পুলিশ গিয়ে কোন আসামী গ্রেফতার করবে, আগে আমাদের বাড়িতে যেত, ভাত পানি খেত, তারপর রাত্রিযাপন করতো। আমার জেঠাকে জিজ্ঞেস করতো আসামীটাকে গ্রেফতার করবে কি না। আমার জেঠা যদি বলতো গ্রেফতার করতে, তাহলে করতো। আর যদি বলতো লোকটা তো গরিব, ওকে গ্রেফতার করলে বউ-ছেলেমেয়েরা না খেয়ে মরবে, তাহলে রাতটা আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে পরের দিন সকালে তারা থানায় চলে যেত। এই ছিলো, আমার পরিবারের দাপট। আর আমি এই পরিবারেরই একজন সন্তান। আমার অন্য এক জেঠা কবি এজাজ ইউসুফীর নানা, চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। আমার বাবা চমৎকার হারমোনিয়াম বাজাতেন, গাজির গান, পুঁথি পাঠ করতেন। কবি এজাজ ইউসুফীর নানা, আমার জেঠা, উনিও চমৎকার পুঁথি পাঠ করতেন। ওই সময় ওটাই ছিলো সমাজের কালচার। যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, কবিগান এগুলোই ছিলো তখনকার সময়ে আমাদের সংস্কৃতির মূল অঙ্গ। আরও ছিলো বলি খেলা, ষাঁড়ের লড়াই আর কুস্তি খেলা। তাছাড়াও নাচ হতো- আমরা বলতাম ‘নাট্য পোয়ার নাচ’। আমি ছোটবেলায় এসব দেখার জন্য পাগল ছিলাম। দূর-দূরান্তে তখন যাত্রা গান হতো। ছোট ছিলাম বলে যেতে পারতাম না। তবে একটু বড় হওয়ার পর মহামুনিতে গিয়েছিলাম যাত্রাপালা দেখতে। আমরা স্কুলেও যাত্রাপালা করতাম তখন। স্বভাবতই তখন আর্থিক সংকট ছিলো। সবার হাতে হাতে এত এত টাকা ছিলো না। তাই স্কুলের উন্নয়নে এককালীন কেউ অনেক অর্থ দান করতে পারতো না। স্কুল ভবন তখন পাকা করার জন্য কিংবা স্কুলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গ্রামে যাত্রা গানের ব্যবস্থা হতো। যাত্রাপালার টিকিট বিক্রির অর্থ দিয়ে স্কুলের উন্নয়নের কাজ হতো। এগুলো মূলত তখনকার সময়ে আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিলো। আর আমার ঐ পরিমন্ডলেই বেড়ে উঠা। একটা সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যেই আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে। আমি কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলাম। বাড়ির মধ্যে প্রত্যেকের প্রতি প্রত্যেকের অনেক মায়া মমতা ছিলো তখন। একটা বড় মাছ পাওয়া গেলে সেটা উঠানে রাখা হতো। মজার বিষয় হলো আমার মাকে সবাই খুব মান্য করত। আমার মাকেই দায়িত্ব দেওয়া হতো মাছটা কাটতে। এরপর সেটা প্রতিটি পরিবারের মধ্যে সমান সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হতো।
আহমেদ মনসুরঃ আপনার শিক্ষা জীবন সম্বন্ধে একটু শুনতে চাই।
সিদ্দিক আহমেদঃ বাড়ির কাছেই স্কুল ছিল, গশ্চি প্রাইমারী স্কুল। ওখান থেকে এরপর ক্লাস সেভেনে চলে যাই নোয়াপাড়া স্কুলে। সেই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পাস করি ১৯৬১ সালে। ঢাকা বোর্ডর আন্ডারে লাস্ট মেট্রিকুলেশান পরীক্ষা দিয়েছিলাম আমরাই। এর পরের বছর থেকেই মেট্রিকুলেশন নাম আর ছিলো না, ঐ পরীক্ষার নাম হয়ে যায় এস.এস.সি। এরপরে আমি ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। আমার বাবার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিলো, কিন্তু তখন হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। তাঁর তখন কেরোসিনের ডিলারশীপ ছিলো নোয়াহাটে। এছাড়াও হেন কোন কাজ নেই, যা তিনি জানতেন না। তিনি ফার্নিচারের কাজ পারতেন। আমাদের বাড়ির সমস্ত ফার্নিচারগুলো তাঁর হাতেই তৈরি। তিনি আবার সেলাইয়ের কাজও জানতেন। ছোট বেলায় আমাদের যাবতীয় কাপড়গুলো তিনিই সেলাই করে দিতেন। বিশেষ করে বোরকা সেলাইয়ের জন্য তিনি ছিলেন বিখ্যাত। এছাড়াও তাঁর ধানের কল ছিলো। এসব নিয়ে তাঁর জীবনটা একেবারে খারাপ কাটেনি। পরে হঠাৎ তাঁর ব্যবসায়টা খারাপ হয়ে গেলো। একান্তই বাধ্য হয়ে তাই তিনি বললেন, আমাকে সিটি কলেজে নাইট সেশনে পড়তে হবে। মাত্র ১৭ বছর বয়স তখন। সবে মেট্রিকুলেশন পাশ করলাম। সিটি কলেজে নাইট সেশনে ভর্তি হলাম। সেটা অবশ্য আমার জন্য ভালই ছিল। আমি জীবনে কোন কিছুকেই নেগেটিভ মনে করতাম না। নেতিবাচক যেকোন কিছুর মধ্যেই আমি মনে করতাম আমার জন্য কিছু বেনিফিট লুকায়িত আছে। সে যেকোন কিছুর ক্ষেত্রেই যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতিও আমার জীবনে পজেটিভ ভূমিকা রেখেছে। নাইট কলেজে ভর্তি হলাম। বাবার ব্যবসায়ের অবস্থা ভালো না তো; তাই চাকরী করতে হবে। ঐ যে কবিরাজ বিল্ডিং এখন ভেঙ্গে গেছে, ওখানে ছিলো ইন্টারন্যাশনাল টাইপিং সেন্টার। ওখানে আমি টাইপ শিখলাম। এরপরও চাকরী হয় না। তবে টাইপে আমার গতি ছিলো খুব ভালো। এর জন্য পুরস্কার পেয়েছিলাম। আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের বিখ্যাত নেত্রী নীলা সেনগুপ্তা। একটা সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। নাইট কলেজে পড়ে আমার লাভটা সবচেয়ে বেশি হলো, ক্লাস ছিলো রাত্রে। সারাদিন আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকান সেন্টার ওই সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে শুধু পড়তাম। ওইটাই ছিলো আমার প্লাস পয়েন্ট। সারাদিন নানা জায়গায় পড়ে কাটাতাম আর রাত্রে কলেজে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলতাম, আড্ডা মারতাম। ক্লাস তেমন হতো না, পড়ালেখাও তেমন করতাম না। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন যখন শুরু হলো। বিখ্যাত সেই আন্দোলন। আমার বয়স তখন আঠারো বছর। ওই আন্দোলনের আমি ছিলাম ওয়ান অফ দ্যা পার্টিসিপেন্ট। কোর্ট বিল্ডিং এর সামনে মিলিটারীর গাড়িতে ইট পাটকেলও মেরেছিলাম। পরে আমাদের টার্গেট করে, ধরার জন্য পুলিশ তাড়া করে। আমরা টিআইসির অপজিটে নন্দন কাননের গলিতে ঢুকে গেলাম। পুলিশও আমাদের পেছন পেছন এই গলিতে ঢুকলো। ঐদিকে আবার ডিসির পাহাড় থেকে পুলিশ নামলো। গলির উভয় দিক থেকে পুলিশ আসতে শুরু করলে আমরা পড়ে গেলাম মহাবিপাকে। আমাদের মধ্য থেকে প্রায় বিশ চল্লিশজনকে গ্রেফতার করে ফেললো তারা। একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ মনে হয় ঐদিন পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ওখানে বিহারী একটা পরিবারের বাসা ছিলো। আমি ওখানে উঠে যাই। ওখানে একটা নারকেল গাছ ছিলো। ছোট খাটো গড়নের ছিলাম তো, আমি ঐ গাছটার আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে ছিলাম, আমাকে ওরা দেখতে পেলো না। সবাইকে নিয়ে পুলিশ চলে গেলো। তারপর আমি ওখান থেকে নামলাম। বাড়ির ওরা আমাকে দেখে জিগ্যেস করেছে, উর্দুতে, তুমি কোথায় ছিলা এতক্ষণ? আমি তো উর্দু জানি না, তাই জবাব না দিয়েই চলে গেলাম। তখন দেখতে পেলে ওরা আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতো। বিহারী ছিলো তো! পরে তিনদিন পর আমার বন্ধুদের ছেড়ে দেয়। ওখানে তিন/চারজন আমার ভালো বন্ধু ছিলো, সিটি কলেজের। আমি জেলে গিয়ে মালা দিয়েও বরণ করলাম একজনকে। পরে ভাবলাম যে, আহারে, আমিও যদি এরেস্ট হতাম আমাকেও তো কেউ না কেউ একটা মালা দিত। জীবনে জেলখানার স্বাদটা আর পাওয়া হল না। সিটি কলেজ থেকে কোন রকমে ইন্টামিডিয়েট পাস করার পর পড়ালেখা আর করলাম না। সবাই আমাকে মনে করে আমি খুব স্কলার লোক, তাই না? কথাবার্তা ভালো বলতে পারি, কিছু লিখতে পারি বলেই হয়ত তেমনটা মনে করে।
আহমেদ মনসুরঃ স্কলার হবার জন্য কি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার খুবই প্রয়োজন?
সিদ্দিক আহমেদঃ লাগে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দরকার আছে। পদার্থ বিজ্ঞানের কঠিন সব তত্ত্ব; সে বিষয়ে তোমার প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে এর কিছুই বুঝবে না। অর্থনীতিতে তুমি অনার্স মাস্টার্স না করলে তুমি অর্থনীতির একদম মূল তত্ত্বগুলো বুঝতেই পারবে না। পরিসংখ্যানের উপর ডিগ্রি না নিলে তুমি পরিসংখ্যানের মূল বিষয়বস্তুর কিছুই বুঝবে না। এ জন্যই একাডেমিক শিক্ষার খুব প্রয়োজন। সে অর্থে একাডেমিক শিক্ষা বলতে আমার কিছুই নেই, একেবারে শূন্য। আমি সেটা অনেককেই বলি, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। মঞ্চে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলি, আমার সামনে যারা বসে আছেন প্রত্যেকেই আমার চেয়ে শিক্ষিত। সবাই লিখতে পারেন বি.এ, এম.এ ডিগ্রী। আমার কিছুই নেই। কিন্তু সবাই মুখে মুখেই আমাকে অনেক ডিগ্রী দিয়ে দিয়েছে। সবাই মনে করে যে আমি অনেক কিছুই জানি। আমার আসলে সেরকম কোন ডিগ্রী নেই। তবে লেখাপড়া যা জানি নিজ তাগিদেই শিখেছি। মুখে মুখে আমি অনেক কিছু জানি এমনটা বলে বেড়ায় সবাই, সে কারণেই কিংবা ওরা কম লেখাপড়া করে বলেই হয়ত মনে করে আমি অনেক কিছু জানি। আসলে আমি তেমন কিছুই না। তবে আমি সবসময় বলি সেটা, আমি কখনো নিজেকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করিনি। সামান্য জ্ঞান নিয়ে, সামান্য দক্ষতা নিয়ে, ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে আমি কিছু করিনি। আমার ইংরেজির উপর দখল ছিলো। অনুবাদও করেছি অনেক কিছু। অনেকে মনে করে চট্টগ্রামে দশ/বার জন যারা ভালো অনুবাদ করে আমিও তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু আমি মনে করি যে, আমার যা হওয়ার কথা ছিলো, যা করার কথা ছিলো তা আমি হইনি কিংবা করিনি। শুধু আমাকে সবাই ভালোবাসে বলেই মনে করে যে, আমি অনেক কিছুই জানি, ভালো লিখতে জানি, ভালো অনুবাদ জানি। এর কারণ হলো ঐ একটাই যে, লোকে আমাকে আসলেই খুব ভালোবাসে। এক লোক সিঙ্গাপুরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন, আমার ব্যাপারে কার থেকে শুনে আজাদী অফিসে কয়েকবার আসলেন আমার সাথে দেখা করতে। তিনি ডক্টরেট ডিগ্রীধারী একজন বড়ুয়া ভদ্রলোক ছিলেন। বাড়ি খুব সম্ভবত রাঙ্গুনিয়া নয় পটিয়ার ওদিকে হবে। উনি আমার হাত নিলেন, হাতটা গণলেন না, তালুতে টিপলেন। টিপতে টিপতে বললেন যে, আপনি যা নন, তার থেকে বেশি সম্মান পাবেন, আপনি যা নন, তার থেকে বেশি জনপ্রিয়তা পাবেন। পরবতীর্তে আমি দেখলাম যে, উনার কথাটাই সত্যি হলো। আমি যা নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি সম্মান, জনপ্রিয়তা পেয়েছি। এটা হয়ত মুরব্বীদের দোয়া, হয়ত বন্ধুদের ভালোবাসা। হয়ত সবাই আমাকে সেভাবে দেখে বলেই আমার এত জনপ্রিয়তা। আমার নিজস্ব কোন আলো নেই, বন্ধুদের আলো দিয়েই আমি আলোকিত হলাম।
আহমেদ মনসুরঃ আপনার তো বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। শিক্ষকতা করলেন, সাংবাদিকতাও করলেন। আবার সাহিত্য চর্চাও করেছেন। আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই এসবের বিস্তারিত।
সিদ্দিক আহমেদঃ আমার কর্ম টর্ম কি আবার? বিশেষ কিছু নেই। সবাই যা করে, করেছি। হ্যাঁ, ওটা একটু বলি। আমি ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে গ্রামে চলে যাই। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। খেলাঘরও করতাম। ৬২, ৬৩ সালে সবুজাঙ্গনে খেলাঘর করলাম। ৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি হলাম, দক্ষিণ রাউজান থানার। ৬৬ সালে আমি চাকরী করলাম আমিন জুট মিলে। পরে আমি কৃষক কনফারেন্সে যোগদান করার জন্য চাকরী ছেড়ে দিলাম। ৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার কৃষক কনফারেন্স হয়েছিলেন রাউজানের লাম্বুরহাটে। তৎকালীন সময়ে অনেক বড় বড় আর বিখ্যাত নেতারা এসেছিলেন সেখানে- মাহতাব আলী খান, মহিউদ্দিন আহমদ, আহছাব উদ্দিন আহমেদ, হাজী দানেশ, কিংবা হাসেম আলী খানও এসেছিলেন। আমিন জুট মিলে চাকরী করেছিলাম মাত্র ৫/৬ দিন। পরে চলে গেলাম ঢাকায়। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় গিয়ে টিউশনি ধরলাম। টিউশনি দিয়েছিলেন আমার এক আত্মীয়, আমার মামাত ভাই মোঃ ওয়ালী উল্লাহ, বিখ্যাত সম্পাদক। উনি ‘আজাদ’ আর ‘সংবাদ’ দু’টি পত্রিকারই সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে উনি দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক ছিলেন। উনার হাত দিয়েই পূর্বদেশ পত্রিকাটি দৈনিক হয়। উনি আবার ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’ এর সম্পাদক ছিলেন। ওটা বার্মা থেকে বের হতো। আমি তাঁর ছেলে মেয়েদেরকেই পড়াতাম। আমি তখন খেলাঘরে যেতাম, আড্ডা মারতাম। ওখানে তখন অনেকেই আসতেন। এখন তাঁরা প্রত্যেকেই অনেক বড় বড় সাংবাদিক। ওখানে জিয়াউদ্দিন ছিলো আমার বন্ধু, বেলাল চৌধুরীর ভাই, আখতার হুসেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সে দুই/তিন বছর আগে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলো। তাদের সাথে আমার ঘনিষ্ট একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায়। পরে যাই হোক সংবাদের বজলুর রহমান, আমার খেলাঘরের ভাইয়া, মতিয়া চৌধুরীর জামাই। পরে তিনি ‘সংবাদ’ এর সম্পাদক হয়েছিলেন। উনি আমাকে খিলগাঁও স্কুলে একটা চাকরী ঠিক করে দিলেন ১৯৭০ সালে। ক্লার্ক কাম টিচার। কতক্ষণ কেরানীগীরী কতক্ষণ মাস্টারী। আমি মূলত ক্লার্ক ছিলাম, তবে কোন শিক্ষক না আসলে তার ক্লাসটা নিতাম। অনেকটা প্রক্সি দিতাম। আমি ওখানে ১৯৭১ সালের জুলাইয়ের ৫ তারিখ পর্যন্ত ছিলাম। দেশের অবস্থা তখন খুবই খারাপ। স্কুল থেকে হঠাৎ জানানো হলো কাউকে বেতন দিতে পারবে না। আমি খাবো কি? তখন সিদ্ধান্ত নিলাম চট্টগ্রাম চলে যাবো ঝুঁকি নিয়ে হলেও। একদম জীবনের পুরো ঝুঁকি নিয়ে চলে আসলাম। পথে ঘাটে অনেক ঝামেলা। আমরা যে বাসে এসেছিলাম ওইটাই ছিলো লাস্ট বাস। পরে আর কোন গাড়িই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসতে পারেনি। কোন রকমে চট্টগ্রাম এসে গেলাম। মদুনাঘাটে মিলিটারীর চেকে পড়লাম। সে অনেক কাহিনী। সেটা আর বললাম না আর কি! কোনরকমে বাড়িতে চলে এলাম। গ্রামে এসে যোগ দিলাম গশ্চি হাই স্কুলে। এর আগে যখন ঢাকায় ছিলাম ১৯৭০ সালে ‘একতা’ পত্রিকায় চাকরী করেছিলাম কিছুদিন। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি হয়েছিলো ঐ ‘একতা’ পত্রিকায়। বজলুর রহমানই আমাকে সেই চাকরীটা দিয়েছিলেন। ওখানে আবদুল হালিম নামের এক অধ্যাপক ছিলেন উনি প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের আত্মীয় লাগে। খিলগাঁও স্কুলের মাস্টারী সাথে কেরানীগীরী আর ‘একতা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা ওসব একসাথেই করেছি আমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রেও আমি কাজ করছিলাম ‘একতা’ পত্রিকার অফিসে। সেদিন বাসায় ফিরতে রাতের সাড়ে এগারোটা বেজেছিলো। আমি তখন রামকৃষ্ণ মিশন রোডে একটা বাসায় থাকতাম। আসতে আসতেই দেখলাম যে আর্মিদের তান্ডবলীলা শুরু হয়ে গেছে।
আহমেদ মনসুরঃ ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর নারকীয় তান্ডবের চিত্র স্বচক্ষেই দেখলেন। তার উপরে কোন কিছু লিখলেন না?
সিদ্দিক আহমেদঃ আমি ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় গিয়েছিলাম। ওটার উপর আমার একটা লেখা আছে। খিলগাঁও স্কুল থেকে ছাত্র শিক্ষকরা মিলে মিছিল সহকারে সবাই গিয়েছিলাম সেদিন। আমেরিকায় একজন একটা পত্রিকা বের করতেন সাংবাদিক মহসিন কাজীর ভাই। ঐ পত্রিকার জন্যই ৭ই মার্চের উপর একটা লেখা লিখেছিলাম। পত্রিকার একটা কপি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। এখন সেটি আর খুঁজে পাচ্ছি না। ২৫শে মার্চের ঘটনা নিয়েও একটা লেখা লেখা যেতে পারতো। এখন আর সম্ভব হবে না। আমার কলম চলে না, মন চলে না, আমি বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না।
আহমেদ মনসুরঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আপনি চট্টগ্রামে ছিলেন, যুদ্ধে অংশ নেন নি?
সিদ্দিক আহমেদঃ যুদ্ধ চলাকালে আমি বাড়িতেই ছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনক ছিলাম। আমি গ্রামের প্রায় পঞ্চাশ জন ছেলেকে সংগঠিত করে ট্রেনিং এর জন্য ভারতে পাঠিয়েছিলাম। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলো আমার বন্ধু সুধীর দাশ। সেই এদের সবাইকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো। সুধীর দাশ পরে ক্যান্সারে মারা যায়। এরকম দেশপ্রেমিক মানুষ ভেরি রেয়ার। সে মিলিটারীর হাতে বন্দি হয়েছিলো। অমানবিক টর্চারের পরেও সে কোন তথ্য ফাঁস করেনি। তক্তার উপর তক্তা দিয়ে সে কি নির্যাতন। সমস্ত চিঠিগুলো সে গিলে ফেলেছিলো। স্বাধীনতা পদকটি তার প্রাপ্য ছিলো, অথচ পেল না। সম্মুখ সমরে অংশ না নিলেও মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলাম আমি।
আহমেদ মনসুরঃ তখনও তো আপনি বিয়ে করেন নি?
সিদ্দিক আহমেদঃ না, করিনি।
আহমেদ মনসুরঃ ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর আর কোন কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন নি?
সিদ্দিক আহমেদ ৭১ সালের জুলাইয়ে গ্রামে ফিরে এসেই আমি গশ্চি হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। পরে ৭৯ সালের মার্চে আমি স্কুলের চাকরী ছেড়ে দিলাম। সেই বছরেই এপ্রিলের ২৮ তারিখেই বিয়ে করলাম। সবাই চাকরী ধরে বিয়ে করে আর আমি করলাম চাকরী ছেড়ে দিয়ে, একেবারে বেকার হয়ে। বাপের কিছু জায়গা জমি ছিলো তো; গরু-ছাগল ছিলো, চাষ-বাস নিয়েই ছিলাম। পরে একটা ঔষুধের দোকান দিলাম। ওটাও চলে গেল। অনেকগুলো টাকা লস হলো। পরে গ্রামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করলাম- ‘গশ্চি শিশুবাগ’। যদিও সেটা এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে আমার বন্ধু বিপ্লব বিশ্বাস একটা পত্রিকা করলো ‘মৃগয়া’। নামটা আমার দেওয়া। এটা ছিলো লিটল ম্যাগ। নামে বেনামে এই পত্রিকায় আমি কলাম লিখতাম। আটটি সংখ্যা বের হয়েছিলো পত্রিকাটির। সবগুলো সংখ্যাতেই আমার লেখা ছিলো। লেখাগুলো আবার আমার বই ‘প্রভৃতি’তেও সংযুক্ত হয়েছে। এই যেমন- ‘কবিতার রাজনীতি’, ‘গোপন সুন্দরবন’, ‘পিকাসো’, ‘কবিতা হয়ে উঠা’ প্রভৃতি লেখা। এরপর ১৯৮৩ সালে দৈনিক আজাদীতে চাকরী পেয়েছিলাম। আমি যোগদান করিনি। আমার মা বলেছিলো, আমি অসুস্থ তুমি যেও না। আমি যাইনি। পরে চাকরীটা পুনরায় পেলাম ১৯৯১ সালে। অরুণ দাশগুপ্তের কারণেই পেয়েছিলাম চাকরীটা। অরুণ দাশগুপ্ত আমাকে সাংবাদিক বানালেন। যদিও সাংবাদকতায় আমার হাতেখড়ি হয়েছিলো ‘একতা’ পত্রিকার মাধ্যমে। সেটা এখনো বের হয়। আজাদীর মাধ্যমে নতুন করে সাংবাদিক হলাম। খবরটা পাঠিয়েছিলেন প্রদীপ দেওয়ানজী। চাকরীটা পাওয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা ছিলো যদিও অরুণ দাশগুপ্তের। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত একটানা চাকরী করলাম দৈনিক আজাদীতে। দীর্ঘ পঁচিশটা বছর। আমি প্রথমে সেখানে সাব এডিটর ছিলাম। পরে হয়েছিলাম সহকারী সম্পাদক। খুব সম্ভবত ১৯৯৮ সালেই, আজাদীতে একটা নতুন পাতা বের হয়, ‘আজমিশালী’। এম. এ মালেক সাহেবের সম্মতিতে সানজিদা মালেকের উদ্যোগে এটা হলো। আমাকে বলা হলো যে, এই পাতায় রিগুলার আমাকে একটা করে লিখা লিখতে হবে। এটার শিরোনাম ঠিক করা হলো ‘খোলা জানালা’। এই নামটি ঠিক করেছিলো প্রদীপ দেওয়ানজী। আমি কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ শ লেখা লিখেছি সেই পাতায়। আমার যে জনপ্রিয়তা সে ঐ খোলা জানালার কল্যাণেই। খোলার জানালার মাধ্যমেই লোকে আমাকে চিনলো, আলাদাভাবে। এর পুরো কৃতিত্বটাই একমাত্র সানজিদা মালেকের। উনি যদি পাতাটা বের না করতেন, মালেক সাহেব যদি সম্মতি না দিতেন তাহলে সিদ্দিক আহমেদ এর এত লেখা কোন দিনই প্রকাশিত হতো না। লোকে বলতো যে, আমার লেখাগুলো ভালো, চমৎকার। অনেকে এখনো আমার সেসব লেখা মনে রেখেছে।
আরো একটা বিষয় হলো ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যদি দৈনিক আজাদী বের না করতেন, ১৯৬০ সালে, সিদ্দিক আহমেদ তাহলে সাংবাদিক হতো না। আমি গ্রামে থেকে হয়ত হাল-চাষ করতাম, নয় মাস্টারী করতাম। আমার সেই ‘শিশুবাগ’ এখন ফুলে-ফলে অনেক বড়। আমার অবর্তমানে গ্রামের ছেলেরা ঐ স্কুলের হাল ধরেছে। এদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ব্যবসায়ী। এরা সবাই মিলে চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকা খরচ করে স্কুলের বিল্ডিং করেছে। ঐ স্কুলের এখন দুইটা বিল্ডিং, একটা ভাড়া, আরেকটা নিজস্ব। এখন ক্লাস এইট পর্যন্ত চলে। আমাকে তারা স্কুলের সভাপতির পদে রেখেছে। ভালোবেসে, শ্রদ্ধাভরে ওরা আমাকে সভাপতির পদটা দিয়েছে। যদিও স্কুলের এই পরিবর্তনে আমার কোন ভূমিকা নেই। এই নামে স্কুলটা আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম বলেই হয়ত ওরা আমাকে মনে রেখেছে।
আহমেদ মনসুরঃ আপনি তো মূলত প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ, সাহিত্যের এই তিনটি শাখাতেই কাজ করেছেন। পাশাপাশি দীর্ঘ একটা সময় ধরে সাংবাদিকতাও করেছেন। আমি এই পর্যায়ে কবিতা বিষয়ে একটু জানতে চাই। বিশেষ করে এখন যে উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে কথা হয়, এ নিয়ে আপনার কি মত?
সিদ্দিক আহমেদঃ উত্তরাধুনিক কবিতা; সেটা তো একটা বিরাট তত্ত্ব। এক লাইনে এটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা ব্যাখ্যা করতে হলে ডাউস ডাউস প্রবন্ধ লিখতে হবে। কবিতা বিষয়ক কোন কথা আমি বলতে চাই না। প্রথমত আমি কবি নই, দ্বিতীয়ত কবিতা বিষয়ক যেকোন বিষয়ই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এক লাইনে মন্তব্য করলে বিতর্ক তৈরি হয়ে যাবে। আমার যে একটা কবিতার বই বেরিয়েছে, ওটা স্রেফ ‘আজ মিশালীর’ পাতা যেহেতু পুরাতে হবে, একটা লেখা দিতেই হবে, কোন সপ্তাহে যদি প্রবন্ধ লিখতে না পারতাম তখন পাতা ভরানোর জন্য কবিতার মতো একটা কিছু লিখে দিতাম। এটা কিন্তু আমি কবিতা লিখার জন্য লিখি নাই, পাতা ভরানোর জন্যই। জাস্ট সবাইকে বুঝানোর জন্য যে ‘খোলা জানালা’য় আমি আছি। আমি শখ করে পুরো জীবনে একটাও কবিতা লিখি নাই। কাজেই উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে এক লাইনে আমি কিছু বলতে চাই না, যেহেতু এটা একটা বিরাট তত্ত্ব। সারা বিশ্বেই এ নিয়ে আলোড়ন হয়েছে। এছাড়াও আরো একটা তত্ত্ব আছে, পরাবাস্তব কবিতা। এটাতে আব্দুল মন্নান সৈয়দ খুব সফল কবি। উত্তরাধুনিক কবিতা নিয়ে চট্টগ্রামেও অনেকে কাজ করেছে। এজাজ ইউসুফী, উনি তো এর উপর একটা বইও লিখেছেন। বইটা আবার উৎসর্গ করেছেন আমাকে। আরো আছেন- জিললুর রহমান, পুলক পাল, সোহেল রাব্বী। আর আধুনিক মানে কি? আধুনিক মানে সমকাল। মাইকেল মধূসুদন দত্ত গীতিকবিতার বৃত্ত ভেঙে নতুন একটা ধারা তৈরি করলেন। তখন তিনি আধুনিক। সমকালে তিনি আধুনিক। বিহার লাল চক্রবর্তী তখন আধুনিক। রবীন্দ্রনাথের ভাবী একবার রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে, তুমি বিহার লালের মতো কবিতা লিখ। বিহার লাল সেসময় আধুনিক ছিলো। সমকালে আধুনিক। তবে এখন তারা আধুনিক না। শামসুর রাহমানও এখন আধুনিক না। এখন যারা লিখছে তারাই আধুনিক। ভাষার পেট্রার্ন উপস্থাপনার পেট্রার্ন সমস্ত কিছুই তো চেঞ্জ হয়ে গেছে। কাজেই উত্তরাধুনিক তত্ত্বটা আমি মানি আর না মানি এটা বিশ্বব্যাপী একটা আন্দোলন ছিলো। ওয়েস্ট বেঙ্গলে ছিলো, ইস্ট বেঙ্গলেও ছিলো। এখন হয়ত সেটার জোয়ার একটু কমে গেছে। ওরকম হয়। কবিতায় আরো একটা তত্ত্ব ছিলো, বিজ্ঞান কবিতা। সেই অনেক আগে থেকেই। একটা বই দেখেছিলাম, আজ থেকে তিন শ বছর আগে জার্মানীর কবিতায় বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো কিভাবে এসেছিলো তা নিয়ে। সমকালের বিজ্ঞান চিন্তাগুলো আর কি! এবং সেখানে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানচিত্রের কল্পনাও ছিলো। ওই বইটা আমি যদিও সংগ্রহ করতে পারিনি। অবশ্য বুঝতামও না সেটা। কারণ ওটা ছিলো জার্মান ভষায় রচিত। অবশ্য হেডিংগুলো ছিলো ইংরেজিতে, ভাবছিলাম যে পড়তে না পারি কি হয়েছে, একটা বই থাকুক না; তেমনি অনেক বই-ই তো আছে- ফ্রেঞ্চ ভাষা, স্পেনিস ভাষা, আরবী ভাষা, উর্দু ভাষা প্রভৃতি। ওসব ভাষা কি আমরা সবাই পড়তে পারি? একটা মানুষের সৃষ্টি তো সেটা। তো থাকবে; আমি ভালোবাসি। যেহেতু আমি নিজের ভাষাকে ভালোবাসি। গ্যাটে বলছিলেন, ‘‘যে নিজের ভাষাকে ভালোবাসে না, সে পৃথিবীর আর কোন ভাষাকেই ভালোবাসতে পারবে না। আর যে একটা বিদেশী ভাষা ভালো জানবে না, সে নিজের ভাষাও ভালো জানবে না।’’ এজন্যই আমি চেষ্টা করেছি সারা বিশ্বকে জানতে। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে গর্তের মধ্যে আমি থাকতে চাইনি। আমার একটা প্রচেষ্টা ছিলো- চট্টগ্রামের মানুষ কেন আমাকে নতুন কথা শুনাবে, আমিই শুনাবো। সাহিত্য বলো, চলচ্চিত্র বলো, যেকোন বিষয়ে। এটা আমার গর্ব না, প্রচেষ্টা ছিলো। এর মানে আবার এই নয় যে আমি সবকিছুই জানি কিংবা যা বলেছি সবই সঠিক কিংবা পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান আমি ধারণ করি। আমার চেষ্টা ছিলো, পারিনি। ক্যাপাসিটি কম। আমার শরীরটা যেমন ছোট, জ্ঞানের পরিধিও কম। আলোর দিকেই আমার যাত্রা ছিলো। কিন্তু আলোর দরজায় পৌঁছতে পৌঁছতে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। জগতের অনেক কিছুই আমার জ্ঞানগম্যের বাইরে রয়ে গেলো। অনেক কিছু ধরতে ধরতেই চলে গেলো। এই আফসোস আমার থেকেই গেলো। এবং সেই আপসোসটুকু নিয়েই বোধ হয় আমাকে পৃথিবীটা ছেড়ে চলে যেতে হবে। অনেক কাজ করার ছিলো, কিন্তু করা হলো না। এখন তো আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম। আশা করিনি কখনো এরকম হয়ে যাবো, তবে হয়ে গেলাম। এখানে আমার করার কিছু নেই। এখন যে কয় দিন আছি, সে কয় দিনও আমি আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই। এটা আমার আকাঙ্কা।
আহমেদ মনসুরঃ আপনি খুব ভালো একজন সাহিত্য অনুবাদক। সাহিত্যাঙ্গনে এ নিয়ে আপনার বেশ সুনাম রয়েছে। অনুবাদ সাহিত্যে আপনার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আপেলে কামড়ের দাগ’। অনুবাদে কেন আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন?
সিদ্দিক আহমেদঃ আমি আগেও বলেছিলাম গ্যাটের একটা বক্তব্য। প্রথমে নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে। অন্য একটি ভাষাতেও ভালো পারঙ্গমতা থাকতে হবে, অন্যথা নিজের ভাষাকে ভালোভাবে জানা যাবে না। ইংরেজি ভাষার উপর কিছুটা দক্ষতা আমার ছিলো। কিন্তু সাহিত্যের নানা কিছু জানতে হলে মাতৃভাষা ছাড়াও এই একটি ভাষা জানা থাকা অন্তত জরুরী। কারণ বিশ্বের সমস্ত নামী দামী বইগুলো সব ইংরেজীতে প্রথমে অনুবাদ হয়। আর এটাও পূর্বে একবার বলেছি যে আমি কখনো গর্তের মধ্যে পড়ে থাকতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম অন্য বিশ্বের সমস্ত প্রকারের খবর চট্টগ্রামের মানুষকে আমিই যেন প্রথম শুনাতে পারি। কাজেই অনুবাদের প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ব্যতিক্রম কিছু নয়।
আহমেদ মনসুরঃ আচ্ছা; গদ্য কবিতা নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিলো। অনেকে মনে করে যারা ছন্দ কবিতা লিখতে পারে না কিংবা ছন্দ বুঝে না তারাই গদ্য কবিতার পক্ষে কথা বলে। আপনার কি মত?
সিদ্দিক আহমেদঃ গদ্য কবিতা, সে তো অনেক আগে থেকে ছিলো। মাইকেল মধূসুূদন দত্ত অন্তমিলের খাঁচা থেকে কবিতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তুমি আবদুল মন্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ’ কবিতাটি পড়েছ? পুরোটাই তো গদ্য কবিতা। কি অসাধারণ! গদ্যেরও কিন্তু ছন্দ আছে। গদ্য কবিতাকে তো ওভাবে ছন্দহীন কবিতা বলা যায় না। অন্তমিল হয়ত থাকে না। আর অন্তমিল মানেই তো ছন্দ নয়। রবীন্দ্রনাথ কি গদ্য কবিতা লিখেন নি? মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও যে কবিতা তিনি লিখেছেন ‘রূপ নারানের কূলে’ সেটাও তো ছিলো গদ্য কবিতা।
আহমেদ মনসুরঃ আপনি মূলত প্রবন্ধকার হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ‘খোলা জানালা’ শীর্ষক দৈনিক আজাদীর ‘আজমিশালী’ পাতায় যে অসংখ্য লেখা লিখেছিলেন, এর প্রায়ই তো ছিলো প্রবন্ধ। তাছাড়াও আপনার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রবন্ধের বই। যেমন- ‘পৃষ্ঠা ও পাতা’, ‘কিছু মানবফুল’, জল ও তৃষ্ণা’, ‘প্রভৃতি’। প্রবন্ধকে কি ওভাবে সাহিত্য বলা যায়?
সিদ্দিক আহমেদঃ প্রবন্ধকে বলা হয় জ্ঞান সাহিত্য। তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী; লেখাগুলোই প্রবন্ধ বলে স্বীকৃত। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নন ফিকশন ধরনের হয় বলে একেবারে সাহিত্যের অংশ নয় মনে করা ঠিক নয়।
আহমেদ মনসুরঃ আপনাকে ধন্যবাদ।
সিদ্দিক আহমেদঃ ধন্যবাদ।