সাবিনা পারভীন লীনা
“পাহাড়ের দরিয়ায় খেলা করে আশ্চর্য সব ঢেউ,নানা রঙের ঢেউ। কখনো হলুদে সবুজে মাখামাখি, কখনো ধূসর সাদা,কখনোবা অদ্ভুত এক নীল।এই নীল রঙ খুঁজেছিলাম অনেক অনেক দিন আগে, পুতুল খেলার দিনে।খুব ইচ্ছে হতো আমার পুতুলের গায়ে তেমন একটা নীল শাড়ি জড়িয়ে দিতে।এরপর বহুকাল পেরিয়ে আবার সেই নীলের দেখা পেলাম,পাহাড়ের দরিয়ায়। এখানে গাছের পাতারা মাতাল নাচের নেশায়। কমলা মুখের সাদা সাদা প্রজাপতিরা পথের দুধারে গল্পে মত্ত।পরিযায়ী পাখির মতো আমি বারবার যাই তাদের কাছে,আয়নায় জমে থাকা মেঘদল নিয়ে।থোকা থোকা মেঘ মুঠোয় পুরে উড়িয়ে দেই।সেই নীল পাহাড় কিছু মেঘ নিজের কাছে রাখে,আর কিছু মেঘ উড়ে গিয়ে বসে ছাই রঙের পাহাড় চূড়ায়।এক ঝাঁক ঘাসফড়িং কানের কাছে এসে বলে–সব মেঘ উড়িয়ে দিতে নেই। কিছু মেঘ পাঁজরের হাড়ের নিচে লুকিয়ে রাখতে হয়।তাদের সারাজীবন বইতে হয়,ঝরতে দিতে হয় নিভৃতে…..”
ডায়েরির ফাঁকে কলম খোলা রেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রতীতি।লেখার ঘোরে কলিং বেল এর শব্দটা এতোক্ষণ কানে লাগেনি।দরজা খুলে দেখে রাসেলের মা, এক হাতে কচুর লতি আর লেবু অন্য হাতে জংলী ফুলের ছাপা শাড়ি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
–কই আছিলেন বাবী, একশোবার বেল দিতাছি,দরজা খুলেন না কা? আফনের শরীল ঠিক আছে, মাথা দরছে?
-না না,আমি ঠিক আছি,ভেতরে আসেন।কলিং বেলের শব্দ খেয়াল করিনি।
আরো কিছু বলতে চেয়েছিল রাসেলের মা,কিছু বলতে না দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে–“আপনার নাস্তা সেরে আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যান।”
আজ আর লেখা আসবে না,সকালে পার্থ যা শুনিয়ে গেল তাকে।কী এমন ক্ষতি বিকেলে ঘন্টাখানেক বাচ্চাগুলোকে পড়ালে!
–তোমার কতো টাকা দরকার,আমি দিয়ে দিচ্ছি। অফিস থেকে এসে বাচ্চাদের নিয়ে তোমার ব্যস্ততা দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।আমার প্রতি কোন মনোযোগই তোমার নেই।ওদের মানা করে দিবে।
অফিস যাওয়ার মুহূর্তে প্রতীতি এ নিয়ে আর কিছু বলেনি।কথায় কথা বাড়ালে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিবে।
–মাথায় তেল দিয়া দিমুনি,কি হইছে আফনের? আমার দেরী দেইখা রাগ হইছেন,বুইজছি।
রাসেলের মা টেবিলে চায়ের কাপ রেখে ড্রেসিং টেবিলে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা টেনে বসলো।চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে।হাত দিয়ে নাক ঘষার কারণে বড়সড় নাকফুলটি আলগা হয়ে আছে।নিশ্চয়ই কারো সাথে ঝগড়া করে এসেছে সে।তুলা পুকুর পাড়ের বস্তিতে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ঝগড়া নিত্যদিনের। টয়লেট,পানির কল,গ্যাসের চুলা,ধার-দেনা,এমনকি জমিদারের সাথে কার বেশি খাতির,তা নিয়েও ঝগড়া চলতে থাকে।এখন সেই কাহিনীই তাকে শুনতে হবে মনে হচ্ছে।গত ছয় বছর ধরে সে রাসেলের মায়ের কথা শুনেছে। কুমিল্লার এলিটগঞ্জের এক গরু ব্যাপারীর মেয়ে কী করে কাজের বুয়া হয়ে গেল,স্বামীর মার খেয়ে ও কী করে দুই বাচ্চা নিয়ে বেড়িয়ে এলো-নাকের পানি, চোখের পানি এক করে সমস্ত কথাই বলে গেছে।
–তইন্যা আমার লগে বেইমানি করছে,বাবী।আইজকা হেতেরে আর তার বউয়েরে গাইল্লাইয়া রাখছিনা।মাইনষের উফকার কইরতে নাই।তারে আমি এই ঘর ভাড়া লওনের খবর দিলাম!কেমন হারামী বেডা,এনার্জি বাল্ব লাগাই নাই বইল্লা জমিদারের কানে দিছে!বউয়ের কাছে ভেড়া হইয়া থাকছ, বেডা। মাইনষে কতো ঠেস মারে তোরে।
এই তইন্যাকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন তার কিছু বলার থাকে। তইন্যা যাকে বিয়ে করেছে তার নাম সুন্দরী।বাপ মায়ের দেওয়া কুলসুম নামটি রেল স্টেশনের ঠিকানায় এসে হারায় সে।এখন শরীর একটু ভেঙে পড়লেও যৌবনে যে সুন্দরী ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাজমিস্ত্রীর যোগালীর কাজ করতে গিয়ে তইন্যা তাকে খুঁজে পেয়েছে বটতলী স্টেশনে। রাসেলের মায়ের মতে,তইন্যা আসলে সুন্দরীকে বিয়ে করেনি।দুইজন মধ্য বয়স্ক নর নারীর মধ্যে ‘ভাব ভালোবাস হইছে,একলগে থাকে’।তইন্যা আর সুন্দরীর সংসার একটু অন্যরকম। কল থেকে পানি আনা,রান্নাবান্না প্রায় সময়েই তইন্যাই করে থাকে।রাতে টং দোকানে বসে দুইজনে চা খায়।ঝগড়াঝাটি নেই বললেই চলে।
রাসেলের মা প্রথম প্রথম তাদের দুজনকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো।আজকাল প্রায়ই গালমন্দ করে তইন্যা কে।
—এতো ঢং আর বালা লাগেনা, বাবী। হেতিরেতো রাজরানী বানাই রাখছে। এইসব দেইক্খা,শইলডা জ্বলে,কাঁন্দন আহে।নিজের ঘরের কাম সামলাইয়া দোকানদারি ও করলাম,তবুও রাসেলের বাপের মন পাইলাম না।হায়রে,এক একদিন কী মাইরটাই না দিতো আমারে!তারউফর মাইষের কতো কতা!হেতে নাকি মাইয়া লইয়া কোনায় কোনায় যায়।আর কতো সহ্য করুম!এক কাপড়ে পোলা দুইটা লইয়া বাইর হইয়া পড়ছি।সাথে ছিল বাপের বাড়ির কিছু গয়না।কিছু বেইচ্চা পরথমেই তারে তালাক দেওনের ব্যবস্থা করছি,দিনে দিনে কাগজ ছাড়ছি।
–আপনার অনেক সাহস আছে,এইজন্যই তো আপনাকে এতো ভালো লাগে আমার।
কথাটা যখন প্রতীতি বলছিল,রাসেলের মায়ের মুখে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি তখন।মাথার চুল টেনে উকুন মারতে মারতে বললো–“বাবী,আফনি কি বালা আছেন?আফনার সামনের ফেলেট্ এর বাবী,মানে মাহবুব সাবের বউ কি সুখে আছেন? নাই,কারোডা চোক্কে দেহা যায়,আর কারোডা দেহা যায়না। ”
সাবিনা পারভীন লীনা : কবি ও কথাশিল্পী।