শামসুদ্দীন শিশির
বর্ষার মাতাল করা অপরূপ দৃশ্য যে কাউকেই উদাস করে। এক টানা রিমঝিম ছন্দে ছন্দে বৃষ্টির অবিরাম শব্দে মন পাগল হয় না এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। কবি গুরুর কবিতায় যেমন করে বর্ষা এসেছে ‘ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা ‘। অথবা আমার বর্ষা জলে ভেজা প্রেমের প্রথম কদম ফুল, গীতিকবির গানে, কবিতায় বর্ষা বন্দনা। সব শব্দই বর্ষায় বাংলার চিরায়ত রূপকে সাজানো। আমি যে ভাবে বাংলার বর্ষা কে উপভোগ করেছি তাই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দিন নেই, রাত নেই আকাশ কেঁদেই চলছে। এক দিন, দুদিন করে সাতদিন পর্যন্ত ঝরছে তো ঝরছে থামার কোন নিশানা নেই। এ কয়দিন কালো মেঘে ঢেকে রাখা আকাশ সূর্য মামার দেখা নেই বহুদিন। মেঘলা আকাশে গুড় গুড় শব্দ আর মাঝে মাঝে বিদুৎ চমকানো। পথ ঘাট, মাঠ প্রান্তর, পুকুর জলাশয় জলে টইটম্বুর। মানুষের সীমাহীন কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় গবাদিপশু পাখি সহ একই ঘরে থাকতে হয়।। পানির তোড়ে ঘর বাড়ি ভেসে যায়। তখন কেউ কেউ নৌকায় বসবাস করে।। সাথে গবাদিপশু পাখি নিয়ে যায়।। সে এক অসহনীয় যন্ত্রণা।। নিজের খাবার ব্যবস্থা করা। গবাদিপশুর খাবার ব্যবস্থা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।মানুষের দুর্দশার শেষ নেই।বর্ষায় ছোটরা মজা, আনন্দ একটু বেশিই করে। তাদের কাজ খাওয়া আর জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া আর দীঘির জলে ডুব সাঁতার খেলা। শাপলা শালুক তোলা, মাছ শিকার, বৃষ্টির জলে ভেজা। ইচ্ছে করে কাঁদা মাটিতে আছড়ে পড়া, আম কুড়ানো আরও কত আনন্দ।। সে আর লিখে শেষ করা যাবে না। কখনো কখনো বৃষ্টি আর বজ্রপাত শুরু হয়। তখন বড়রা ছোটদের ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। মা, চাচী, দাদী সবাই মিলে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করতেন।। তখন ঘরের বাইরে কোন কাজ করার কোন সুযোগ থাকতো না। ছোটদের দিয়ে কাঁথা সোজা করে ধরে সেলাইয়ের জন্য সাহায্য নিতেন। এই সুযোগে ছোটরা কাঁথায় গড়াগড়ি খেতো। অনেকেই সুঁইয়ের খোঁচাও খেয়েছে।। অবিরাম বৃষ্টির কারণে মোরগ মুরগী গুলো ঘরের পাশে ঢেলার উপর এক পায়ে ভর করে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে আর ঝিমিয়ে পড়ে। তখন অবশ্য হাঁসদের আনন্দ বেড়ে যায়।। যতদূর চোখ যায় ঘুরে আসে। বর্ষার থৈ থৈ পানিতে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা। গৃহস্তের সংশয় থাকে সন্ধ্যায় হাঁস গুলো ঠিক ভাবে ঘরে ফিরে আসবে তো! নয়তো কাদা জল মাড়িয়ে খুঁজে আনতে হয়।মিষ্টি আলু সেঁকে বা মিষ্টি আলু চুলার ছাইয়ের ভেতর পুড়ে খাওয়া।। কখনো কখনো মা, ফুফু দাদী অবসর থাকলে বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করে দিতেন। বিকেলের নাস্তা বেশির ভাগ সময়ই হতো ডাটা শাক, কচু শাক বা পাট শাক সিদ্ধ সাথে শুকনো মরিচ টালা।। ও একটা কথা বলাই হয়নি আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। একসাথে ১২/১৪ জন বাচ্চা থাকতাম। লম্বা লাইন ধরে বসে নাস্তা, ভাত, ঘুমানো সবই চলতো। সেই ফেলে আসা দিন আহা কি মধুর ছিল। বৃষ্টি থামতে দেরি আমাদের বের হতে দেরি হতো না।
শামসুদ্দীন শিশির: শিক্ষা গবেষক।