বুকোস্কি-কে ভেবে…
পাহাড়ী ভট্টাচার্য।। পুবাকাশ
“I wanted the whole world or nothing.”-বুকোস্কি।
প্রবলতর প্রথাবিরুদ্ধ, বোহেমিয়ান, ভাবলেশহীন, ভীষণ খামখেয়ালীর এক জীবন হেলাফেলায় কাটিয়ে গেলেন তিনি; উচ্চাভিলাষ ও অনুযোগহীন, এক সহজাত নিজস্ব ভঙ্গিমায়!
হেনরী চার্লস বুকোস্কি (জুনিয়র) তাড়িত হয়েছেন নিয়ত তাঁর সৃষ্টিশীল মনো-দৈহিক সত্ত্বা, দৃশ্যমান পরিপার্শ্ব, সময় ও কালধারা দ্বারা। তিনি ভেঙ্গেছেন, গড়েছেনও, সাময়িক হতাশা-অপ্রাপ্তিতে, জাগতিক বৈরিতা-বিরুদ্ধতায় মর্মাহত হয়েছেন; হতোদ্যম কিংবা নিষ্ক্রিয় হননি কদাচ।
মূলত মৃত্যুর পর পাদপ্রদীপের আলোয় আসা এ জার্মান-আমেরিকান কবি, ঔপন্যাসিক-গদ্যকারকে নিয়ে স্বদেশে- মার্কিন মুল্লুকে তো বটেই, ইউরোপেও কম-বেশী অধ্যয়ন, পঠন-পাঠন, চর্চার প্রয়াস ক্রমবর্ধমান।
বোহেমিয়ান জীবনধারা বুকোস্কি-কে জীবদ্দশায় কিছুটা আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনলেও বস্তুত তাঁর লেখালেখি, দর্শন, চিন্তাসূত্র উপেক্ষিত ছিল সুদীর্ঘ- সময়।
“The difference between art and life is that art is more bearable”-বুকোস্কি।
নিন্মবিত্ত পরিবারে জন্ম, দারিদ্র-অনিশ্চয়তায় বেড়ে ওঠা, ২টি মহাযুদ্ধের অভিঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দাকালে মানুষের টানাপোড়ন, মদ্যপ পিতার শারিরীক-মানসিক অত্যাচারে অতিবাহিত শৈশব, কাছ থেকে দেখা সব সম্পর্ক-সূত্রের করুণ পরিনতি, সমাজ-রাষ্ট্রের ক্রমশ: বিবর্তনে অন্তজ নাগরিক জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত-দ্যোতনা বুকোস্কি-কে তাঁর কবিতায়, উপন্যাসে, গদ্যে, কলামে শুধু নয়, প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে ব্যক্তি জীবনে, মননে ও সামগ্রিকতায়। সে চিত্র এঁকেছেন বুকোস্কি, তাঁর লেখায়। আত্মজীবনীর ঢঙে লেখা বুকোস্কি-র গদ্যে পাঠক পাবেন অন্ত্যজ জীবনের কর্কষ বাস্তবতা, কালের বিরূদ্ধতা এবং জাগতিক দ্বৈরথের চিত্রকল্প।
মুক্তির দশক খ্যাত ‘৬০-এর দশকে তাঁর তারুণ্য ও যৌবন আবর্তিত হতে দেখি আমরা অসমাপ্ত অধ্যয়নে, সাময়িক নানা ছোট–খাট কাজে, প্রথাবিরুদ্ধ মার্কিন কবি-লেখক- শিল্পীদের সাহচার্য, “ওপেন সিটি”সহ কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্যের ছোট কাগজে লেখাজোকায়, হিপি আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মিছিলে যুক্ততায়, এ্যালেন গিন্সবার্গ ও অন্যান্যদের সান্নিধ্যে।
পরিশেষে ডাক বিভাগের কাজে যোগদান, লেখালেখির জন্য চাকুরীতে ইস্তফা,
অনিশ্চিত নাগরিকের জীবন বেছে নেয়া, বেঢপ মদ্যপান, নারীসঙ্গে নিমগ্নতা, বারে-পাবে-স্টেশন টার্মিনাসে-বেসমেন্টে-পার্কে ভবগুরের জীবনযাপনের কালেও একদিনের জন্যও এই মানুষটি লেখালেখি-র প্রয়াস থেকে নিবৃত্ত থাকেন নি!
দু’ বার বিয়ে, বিচ্ছেদ, ব্যক্তিক-নিসঙ্গতা তাঁকে মনোদৈহিক- বহুমাত্রিক অভিঘাতের, অনুভবের প্রত্যক্ষদর্শীতে পরিনত করেছে; কবি ও লেখক হিসেবে করেছে অধিকতর আত্ম বলয়ের ঘেরাটোপ-বন্দী, জাগতিক বিচ্ছিন্নতায় মগ্ন এবং অবিশ্বাস্যভাবে, স্বীয় লেখক-সত্ত্বার প্রতি দায়বদ্ধ ও পাঠ-নিবিষ্ট। নি:সঙ্গতা প্রসঙ্গে-
বুকোস্কি-র বিখ্যাত স্বগতোক্তি “I don’t hate people but I feel better while they are not around!”
যাপিত জীবনকে ঘিরে বুকোস্কি-র স্বীকারোক্তি এবংবিধ-
“I was drawn to all the wrong things:
I liked to drink, I was lazy,
I didn’t have a god, politics,
ideas, ideals.
I was settled into nothingness;
a kind of non-being, and I accepted it.
I didn’t make for an interesting person.
I didn’t want to be interesting,
it was too hard.
What I really wanted was only a soft, hazy space to live in,
and to be left alone. On the other hand,
when I got drunk, I screamed,
went crazy, got all out of hand.
One kind of behavior
didn’t fit the other. I didn’t care.”
বছরের পর বছর বুকোস্কি লিখে গেছেন, পত্র-পত্রিকায় পাঠিয়েছেন, প্রত্যাখাত হয়েছে লেখা। তাঁর অজস্র লেখা কপি করেও রাখেননি। পরিশেষে, ব্ল্যাক স্পেরো প্রেস-‘র, স্বত্বাধিকারী জন মার্টিন বুকোস্কি-র রচনাবলি ধারাবাহিক প্রকাশে রাজি হলে লেখকের আর্থিক অনিশ্চয়তা ক্রমশ: দূরীভূত হতে থাকে। বুকোস্কি ও প্রকাশক মার্টিনের মধ্যে-কার পারষ্পরিক সম্পর্কসূত্রটি আমৃত্যু অটুট ছিল।
জন্মসূত্রে জার্মান ও পোলিশ ঐতিহ্য, বিশেষত চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি বুকোস্কি-র লেখক জীবনেও বিশেষ ছাপ রেখেছে। তাঁর কবিতা ও গদ্য স্পষ্ট, সহজ ও তীর্যক, লক্ষ্যণীয়ভাবে, পাঠকের কাছে সন্মোহক, সুতীব্র- তার দ্যোতনা।
এক সাক্ষাতকারে বুকোস্কি বলেছেন, কবি বা গদ্যকার-কে প্রতিটি বর্ণ, শব্দ, বাক্য নির্মাণে হতে হবে যত্নশীল, পরিশীলিত। বাস্তবতা-বিবর্জিত কিছুই, সে অর্থে চুড়ান্তভাবে, পাঠকের কাছে শিল্প-আবেশ কিংবা সুগভীর কোন ভাবাবেগও তৈরীতে অপারগ। বুকোস্কি গণমানুষের বোধগম্য সাহিত্য-ভাষা নির্মাণেই আমৃত্যু প্রয়াসী ছিলেন।
বুকোস্কি-র সাহিত্যিক-জনপ্রিয়তা ও সাফল্য আসে মধ্য ও পরিণত বয়সে। দীর্ঘসময়, তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় স্বীকৃতি-র। তাঁর কলাম ও মুক্তগদ্যের সংখ্যা অনেক। এ অবধি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, গল্প-সংকলন এবং স্মৃতিকথা মিলে মোট গ্রন্হ ৬০-এর অধিক। উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ হল “পোস্ট অফিস”, ” ফ্যাক্টোটাম”, “হ্যাম অন রেই”,” উইমেন”,”পাল্প”, “নোটস্ অফ এ ডার্টি ওল্ড মেন” ও জীবনের অন্তিমপর্বে লেখা নন-ফিকশন “দ্য ক্যাপ্টেন ইজ আউট টু লান্চ এন্ড দ্য সেইলর্স হ্যাভ টেকেন ওভার দ্য শিপ”।
বুকোস্কি-কে কবিতায়, গদ্যে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন জন ফন্তে, ন্যুট হামস্যুন, ল্যুই ফার্দিনন্দ সেলিন, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হেনরি মিলার, ডিএইচ লরেন্স ও দস্তয়ভস্কি।
উদ্দাম যৌনতা ও নারী সংসর্গ বুকোস্কি-কে করেছে কম-বেশী বিতর্কিতও। কবি-র বৈবাহিক সম্পর্ক হয়েছিল দুই নারী বারবারা ফ্র্যয়ি এবং লিন্ডা লি-র সাথে। মার্কিন কবি ও ভাস্কর লিন্ডা কিং-এর সাথেও বুকোস্কি-র দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল। তবে, জেন কুনি বেকার, ফ্রান্সিস স্মিথ, এম্বার ও’ নীল, জোয়ানা বুল প্রমূখও বুকোস্কি-র জীবনে এসেছেন এবং তাঁর কবিতা ও উপন্যাসে-আত্মজীবনীতে সু-চিত্রিত হয়েছেন, পরবর্তীকালে।
১৯৯৪ সনে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছরে মৃত্যু ঘটে হেনরী চার্লস বুকোস্কি-র।
“দ্য লাফিং হার্ট” কবিতায় বুকোস্কি-র অমোঘ আশাবাদ-
“Your life is your life
Don’t let it be clubbed into dank submission.
Be on the watch.
There are ways out.
There is a light somewhere.
It may not be much light but
It beats the darkness.
Be on the watch.
The gods will offer you chances.
Know them.
Take them.
You can’t beat death but
You can beat death in life, sometimes.
And the more often you learn to do it,
The more light there will be.
Your life is your life.
Know it while you have it.
You are marvelous
The gods wait to delight
In you.”
পাহাড়ী ভট্টাচার্য : কবি ও প্রাবন্ধিক। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেন।