স্মরণ
প্রফেসর মোহাম্মদ আলী স্যার: নাতি ছাত্রের মাগফিরাত কামনা
ছরওয়ার আলম।। পুবাকাশ
২৪ জুন ২০২১ এ প্রফেসর মোহাম্মদ আলী স্যার (১৯৩৪-২০২১) ইহলোক থেকে পরলোকে গমন করেছেন। স্যারের আমি নাতি বা পুতি ছাত্র। চট্টগ্রাম কলেজে, আমার বেশিরভাগ শিক্ষক উনার ছাত্র কিংবা ছাত্রের ছাত্র ছিলেন। যতদূর শুনেছি, আলী স্যার কিছুদিন চট্টগ্রাম কলেজে পড়িয়েছিলেন। কলেজের একজন পুরনো কর্মচারীর মুখে সেই সময়ে স্যারের সম্ভ্রম-জাগানিয়া জীবন যাপনের কথা শুনেছিলাম।
২০০১ সালের শেষদিক।তখন আমি রাউজানের একটি এম পি ও ভুক্ত কলেজের শিক্ষক। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের বর্তমান ট্রেজারার Humayun Kabir আমাকে জানালেন, ওখানে বেশ কজন শিক্ষক নেয়া হবে ইংরেজি বিভাগে।আমার দ্বিধা, অপ্রস্তুতি আর কিছুটা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি সত্ত্বেও, আমাকে খানিকটা জোর করে দরখাস্ত করালেন। আমার মাস্টারি ভবিষ্যত নিয়ে উনি অনেক আশাবাদী ছিলেন। তাছাড়া, অতি আইডিয়ালিজমের কারণে, তখনো নিজের ক্যারিয়ারের চাইতে, আমি দেশ-জাতি-সমাজ উদ্ধার নিয়ে বেশি ভাবতাম। যাহোক, আলী স্যারের সাথে আমার প্রথম মুখোমুখি দেখা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির ভাইবা বোর্ডে।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেও, উনি যে জাত শিক্ষক সেটা বুঝে গিয়েছিলাম।
বেশ কয়েকটা প্রশ্নের একটা ছিল, look এবং eye এই দুই ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য কোন জায়গায়। পারি নাই। স্যার উনার সামনে থাকা একটি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে আমাকে গ্রাফিকালি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ভাইবা বোর্ডে স্যারের শিক্ষকতা আমার সারা জীবন অনুসরণযোগ্য স্মৃতির ধন হয়ে আছে।
শুনেছিলাম, স্যার সিলেবাসের বাইরে কি পড়েছি তা নিয়ে সাধারণত জিজ্ঞেস করেন। এরজন্য সেসময় তাড়াতাড়ি কিছু বই বাংলা অনুবাদে পড়ে নিয়েছিলাম। তারমধ্যে, একটি খুশবন্ত শিংয়ের “এ ট্টেন টু পাকিস্তান “। এটি পড়ার সময়, ভাইবার ভয়ের চাইতে, ৪৭ এর রক্তাক্ত দাঙ্গার উপন্যাসিক বর্ণনা আমাকে আপাদমস্তক বিষণ্ন করে রেখেছিল।
স্যারের সাথে অনেকে সশ্রদ্ধ দূরত্ব বজায় রাখতেন।আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। ধীরে সুস্থে, গভীর আন্তরিকতায় এবং নিখাদ বিনম্রতায় সালামের উত্তর দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয় গেটে, বেশ কয়েকবার সালােমের উত্তর শুনার-দেখার সুখস্মৃতি আছে। এধরনের স্থিতধী মানুষ ক্রমাগতভাবে বিরল। আমরা সবাই কেমনজানি, এলিয়টের টাইপিস্ট মহিলার মত স্টার্টের উপরে থাকছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের, বেশকিছুদিন পর আমার এক কাজিনের বাসায় যাই। উনি সেসময় একটি নামকরা বেসরকারি
কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক। উনাকে বললাম, আপনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে ভাল হত। উনি বললেন, আলী স্যারকে ভাইবাতে ফেস করার ভয় থেকে উনি আর আসেননি। আমি নিজেকে নিয়ে ভাবলাম, ” The fools rush in where angels fear to thread.”
চাঁন্দগাও আবাসিকে স্যারের বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আমার এক ভাগিনাদের বিল্ডিং। দেখলাম, স্যারের এক নাতির সাথে ভাগিনার বন্ধুত্ব। সেসময় কলেজে পড়া ভাগিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার বন্ধুর দাদা আলী স্যার সম্পর্কে কি জানে। বন্ধুর দাদা এবং একজন বুড়ো মানুষ- এর বাইরে দেখি সে প্রায় কিছুই জানে না। আমাদের সমাজের মহত্তম মানুষদের লিগ্যাসি কি আমরা হারিয়ে ফেলব? এই সমাজের গভীর অসুখগুলি কোথায়? এরজন্য আমি আমরা কিভাবে দায়ী?
স্যার তেমন লেখাজোখা করেন নি। এ ব্যাপারে স্যারের অনুরাগীদের মধ্যে ও একধরনের অনুযোগ দেখেছি। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক হারুন স্যার একবার আমাকে বলেছিলেন, আলী স্যার নিজের মেধার প্রতি আরো সুবিচার করতে পারতেন। কিন্তু, স্যারের প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীরা একবাক্যে স্বীকার করে যাচ্ছেন শিক্ষক হিসেবে তিনি কত সফল ছিলেন। আহমদ ছফা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের লেখাজোকায় অনীহার বিষয়ে এরকম কিছু বলেছিলেন, সম্ভবত “যদ্যপি আমার গুরু ” তেঃ ‘উনি লেখেন নাই কেন ব্যাপারে আমি বলার কেউ না। তবে, লেখালেখি করে, উনি সম্ভবত যারা লেখালেখি করেন, নিজেকে তাঁদের স্তরে নামিয়ে আনেন নি।’ ছফা আরেক জায়গায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে বেশিরভাগ লেখক পানের দোকানের পুঁজি নিয়ে শিল্পপতি হতে চায়।
বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন অধ্যাপক লেখক সম্পর্কে আমার এক স্যারকে মূল্যায়ন করতে বলেছিলাম। স্যার বললেন, “উনি অনেক লিখেছেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু, কোন একটা অ্যাকসিডেন্টে যদি কিছু মানুষ মারা যায় এবং ঐ অধ্যাপক কে যদি মন্তব্য করতে বলা হয়, উনি সোজাসুজি শুধু বলবেন, দেশে সমাজতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারনে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ” প্রায় মনে হয়, চিন্তার একরৈখিকতা বা বদ্ধতা, জনপ্রিয় হবার দুরারোগ্য খায়েশ কিংবা নৈবর্ক্তিকভাবে সত্য তালাশের কষ্টসাধ্য পথ পাড়ি দেয়া অনেক লেখক অধ্যাপকের হয়ে উঠে না।
এরাই আবার জাতিকে গাইড করার নানা দায়িত্ব নানাভাবে পেয়ে যান, নিয়ে নেন। আমাদের সমাজ রাস্ট্রের সম্ভবত এটা একটা মৌলিক সংকট। এই সংকট উত্তরণে, আলী স্যারের মত গগনবিদারী ব্যক্তিত্ব যিনি বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, প্রশ্নাতীত সৎ জীবনযাপন করেছেন, আত্মমর্যাদাবান জীবনের বটবৃক্ষ হয়েছিলেন- তাঁর কাছে জানার খুব আগ্রহ ছিল।
স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা ছাড়া এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব থেকে সারাজীবন শিখার সাধনাই এখন আমাদের একান্ত কর্তব্য।
ছরওয়ার আলম: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।