স্বজনদের শ্রদ্ধার্ঘ্য
স্মৃতি : এলেবেলে ভাবন।। মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন।।পুবাকাশ
বিদায় মানুষ গড়ার কারিগর-শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ভি,সি মোহাম্মদ আলী”! আমাদের বংশের গৌরব, এই বড় ভাই যদিও পরিণত বয়সেই গত ২৪জুন আমাদের মাঝ থেকে হঠাৎ চলে গেলেন। কিন্তু এই বিদায় তো আমাদের জীবনাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের অস্ত যাওয়াকে বুঝায়।কেননা সমগ্র জীবন সূর্যের আলোর মতো,শিক্ষার আলোই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপনা জীবনে আপামর ছাত্রদের বিতরণ করে গেছেন। যদিও অন্যান্য অধিকাংশ ভি,সি,মহোদয় গন আজকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিমন্ডলে নিজস্ব স্বার্থের জন্য দৌড়ঝাপে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন মোহাম্মদ আলী দা।ফলশ্রুতিতে উনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মন্জুরী কমিশনের সদস্য হিসেবে অত্যন্ত সম্মানের সহিত কর্মজীবন শেষ করেন। অসংখ্য গুণগ্রাহী ছাত্ররা উনার সাহচর্যে সোনালী ভবিষ্যত গড়ার জীবনগঠনে উদ্বুদ্ধ হোন।
যারা আজকের সমাজে বহুক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও আপন আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। এই যেমন বর্তমান প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ভি,সি(অনুপম সেন)মহোদয় কথা প্রসঙ্গে উনার পরিচয় দিলে সাথে সাথে বলে উঠলেন, আরে উনিতো আমারও স্যার”-চট্টগ্রাম কলেজে পড়িয়েছেন।
তাই আমি বলতাম আপনিতো ভি,সি,দের ভি,সি বড়দা।হেসে উঠতেন।কি অমায়িক বাচনভঙ্গি।যা আর কখনো দেখা হবে না।মনে উঠতে মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠে।
প্রসঙ্গতঃআমার আব্বাদের সাত ভাই দুই বোনের বড়ো ভাই এডভোকেট আলী আহমেদ জেঠার বড় ছেলে ভি,সি,মোহাম্মদ আলী (বড়দা)।চল্লিশ /পঞ্চাশ এর দশকে তিনি(এডভোকেট আলী আহমদ) চট্টগ্রাম শহরে খুব প্রতাপশালী আইনজীবী ছিলেন। বিয়ে করেন বাকলিয়ার স্বনামধন্য পরিবারে, আজিম ব্যারিষ্টারের কন্যা(জেঠিমা)সাবেক , মন্ত্রী আরিফ মঈন উদ্দিনের বড়ো বোন।উনার ওঠাবসার আভিজাত্যবোধই ছিলো আলাদা। অসম্ভব রকম শিক্ষানুরাগী ছিলেন। রিয়াজুদ্দিন বাজারের মালিক রফিক উদ্দিন সিদ্দিকীদের সাথে ছিলো ভালো দহরমমহরম সম্পর্ক। বার্ধক্যে ষ্টেশন রোডে বন্ধুবর ইসলাম খাঁ সাহেবের “হোটেল মিসকা”য় উনিসহ চট্টগ্রামের এলিট শ্রেণীর আাদালত খাঁ সাহেবরা সকাল দশটা থেকে বারোটায় একটা নিদিষ্ঠ বরাদ্দকৃত কক্ষে আড্ডা দিতেন। তখনকার দিনে উনাদের জন্য তিনশো টাকা আপ্যায়ন বাবদ ফ্রী ছিলো। তা ঐ আসরে আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে গিয়ে দেখা করার সৌভাগ্য হয়।এবং ফ্রীতে আপ্যায়িত হওয়ার সুযোগ লাভ করি। কেননা ষাটের দশকে উনার ভাগের সমস্ত জমিজমা ভাইদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে স্হায়ীভাবে চট্রগ্রাম শহরে চলে আসেন।গ্রামের সাথে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।শহরের চৈতন্য গলিতে বাস করতেন।তো আমি ঢুকেই পায়ে ধরে সেলাম করি উনার বন্ধুদের আর যথেষ্ট সেলামী লাভ করি। দুপুরে বাসায় খাওয়া দাওয়া শেষে আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে উনার ইজি চেয়ারের (তখনকার দিনে আয়েশী ভংগীতে সটান হয়ে বসা)পাশে বসিয়ে বল্লেন, দেখো নাছির, আমি যখন চট্টগ্রাম শহরে ওকালতি করি চাইলে অনেক স্ব- সম্পত্তি কিনতে পারতাম। প্রচুর আয় ছিলো,যা তুমি কল্পনা ও করতে পারবে না।ভাতিজা হিসেবে কিছু ভাগিদার হতেও পারতে।অথচ আমি এই সেমিপাকা ঘরেই জীবন কাঠিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমার এই ভাইদের লেখাপড়ার পিছনে আমার সব সঞ্চয় নিঃশেষ করেছি। চোখের ক্ষতি হবে মনে করে ইলেকট্রিসিটি আনিনি।বড়ো বড়ো মোমবাতির অর্ডার করে এর আলোয় পড়তে বলতাম। সবাই কে মাস্টার্স কমপ্লিট করিয়েছি প্রথম শ্রেণি লাভের মধ্য দিয়ে। উচ্চতর শিক্ষা যার যার পছন্দ মতো, সাথে বিয়ে শাদীও। শুধু জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম এর সাথে মেয়ের বিয়েটা সাতজন মানুষ এ ঘরে খেয়ে তুলে দিই। পরে ঢাকায় আজকের পি,জি হাসপাতাল, তখনকার হোটেল শাহবাগে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। শুনেছি যেখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান সাহেব ও নাকি অতিথি হয়েছিল। এখন বল দেখি, আমি যদি অগাধ সম্পত্তির মালিক হতাম তাতে তোমরাও হয়ত লাভবান হতে পারতা;আর এখন তোমারভাই গুলো কেউ কানাডা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনায়, কেউ চট্রগাম ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশের হেড অবদা ডিপার্টমেন্ট।(ভি,সি সাহেব তখন ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর প্রধান ছিলেন)।তোমার বোনজামাই এদেশের সেরা ডাক্তার(বর্তমান ইউ,এস,টি,সির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান )এই বোন ও দুই বিষয়ে পি,এইচ ডি করেছিলো। যদিও তাকে পর্দাশীনতার কারনে ডাক্তার সাহেব কোন পেশায় জড়িত হতে দেয়নি। এভাবে একটা মহামূল্যবান মেধা নিঃশেষ হয়ে যায়।তোমার কোনটা পছন্দ? আমি সম্পদের মালিক হলে নাকি, তোমার ভাইবোনদের যেভাবে মানুষ করেছি? ঐটুকুন বয়সে আমি সাথে সাথে বল্লাম, আমাদের আর কি পাওয়ার আছে এর চাইতে বেশী। সারা দেশে আমাদের বংশের বাতির আলো ছড়িয়ে দিছেন এইতো যথার্থ। উনি খুশি হয়ে আমাকে আগবাড়িয়ে দিয়ে হাতে আড়াইশ টাকা দিয়ে বল্লেন, এখন তো আমার অবসরকালীন জীবন।এই টাকাটা দিয়ে তোর কলেজের জন্য ভালো থেকে কাপড়, জুতা কিনে নিস।১৯৭৬ সনে ঐটাকা খুব একটা কমও না।
বস্তুত এ-ভাবে ভি,সি মোহাম্মদ আলী- দারা আদর্শ পিতার আদর্শিক চেতনায় বেড়ে উঠে। যা আজকের সমাজে এক মহীরুহ হিসেবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।তাঁর জীবনাবসান হলেও, একটা প্রদীপ থেকে যেই হাজারো প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন, সবার অলক্ষ্যে শিক্ষার এই আলো শতধারায় বিকিরিত হতে থাকবে সভ্যতা যতদিন থাকবে । জ্ঞান বা শিক্ষার ধর্মই এটা।সমাজ তথা দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই যুগে যুগে শিক্ষার এই মহানব্রতী ফেরিওয়ালাদের প্রতি মনের গভীর থেকে রইলো অজস্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। উনার এই মহাপ্রয়াণ যেন আমাদের মাঝে শোক নয় শক্তিতে পরিণত করে। তাই কায়মনোবাক্যে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে উনার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আমিন।।
মোহাম্মাদ নাসির উদ্দিন : স্বত্বাধিকারী, এন আই সিণ্ডিকেট অটো ইন্ডাস্ট্রি।
স্মৃতি অমলিন : প্রিয় বাতিঘর ।। মফিজুল হক চৌধুরী।। পুবাকাশ
ফটিকছড়ির হাইদচিয়া গ্রামটা এখনো আলোকিত জ্ঞানী, ধর্মীয় পন্ডিত, শিক্ষক,আইনজীবী,সরকারি উচ্চ পদস্থ আমলা ও কর্মকর্তা, স্বনামধন্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি, গীতিকার , বৈদ্যুতিক ব্যবসায়ীদের পদচারণে। যদিও সবাই নিজ নিজ কর্ম নিয়ে ব্যস্ততার কারণে গ্রামে বসবাস করতে পারে না। তবু্ও শেকড় ছুঁতে সবাই কে আসতেই হয় গ্রামের বাড়িতে।
তখনকার প্রাজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন মহব্বত আলী মুন্সি বাড়ির ঠান্ডা মিয়া চৌধুরীর প্রথম সন্তান উকিল আলী আহমেদ। চট্টগ্রাম শহরে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হয়েও নির্লোভ নিরহংকার ছিলেন। তৎকালিন এলিট শ্রেণীর মানুষের সাথে ওনার সম্পর্ক ছিল। চৈতন্যগলিতে নিজস্ব আবাস ছিল। ওনার সম্পদ ছিলো ওনার সন্তানরা। এটা নিয়েই ওনার অহংকার ছিল।
প্রথম কন্যা তৎকালীন সময়ে দুই বিষয় মাস্টার্স ডিগ্রীধারী। বিয়ে দিয়েছিলেন দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যাক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ওনার অবদানের কথা সমাদৃত চিকিৎসা শিক্ষায়। তাঁর বড় ছেলে মরহুম প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী। যাঁর মেধা ও প্রশাসনিক দক্ষতার খ্যাতি চার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব পালনে প্রমাণিত হয়ে যায়।
তিনি আমার সম্পর্কে জেঠা। তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল দুবাই আন্তর্জাতিক কোরান এওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশে থেকে স্কলার হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন, সম্ভবত তখন আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল দুবাই আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারে শেখ আল মাখতুম হলরুমে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইসলামিক স্কলার উপস্থিত ছিলেন। ওনার বক্তব্য শুনে পুরো দর্শক ওনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল। আমিরাতের সকল আরবি খবরের কাগজ আল্ বয়ান,আল্ খালিস।ইংরেজী দৈনিক গালফ নিউজ ও কালিজ টাইমে ওনার বক্তব্য ও আটিকেল ছেপেছিল।
পরবর্তী ওনার সাথে হোটেল সুইটে দেখা করেছিলাম। ওনার আন্তরিক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সৌভাগ্য আমাকে ওনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সহায়তা করেছিলো। মাসে অনন্ত দুই বার আমাকে ফোন করতেন। খুব অল্প আলাপে আমাকে কুশলাদি বিনিময়ের পরে উপদেশ মূলক কথা বলতেন। সেই সৌভাগ্য চিরতরে শেষ গত ২৪ জুন ২০২১ সন্ধ্যা ৬.১০ মিনিটে।
প্রবাসে আপনজনরা কেউ কুশলাদি বিনিময় করলে মনের কস্ট কিছুটা হলেও হালকা হয়। ওনি মাসে অনন্ত দুইবার আমাকে ফোন করতেন। খুবই স্বল্পআলাপ কিন্তু আন্তরিকতা ছিলো সমুদ্রের ন্যায়।
আমার লালখান বাজার বাসায় এসেছিলেন নিজে থেকে কারণ ওনাকে বলার সাহস আমার ছিল না। আমার বড়োবোন নিলুফার ও অধ্যাপক কিবরিয়া ছিলো ওনার খুব স্নেহধন্য। পারিবারিক ব্যাপারে সব শেয়ার করতো তাদের সাথে। গত দশবারো বছর ওনি আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের খুব আন্তরিক ছিল বিশেষ করে মহব্বত, ইমতিয়াজ, ইকরাম, আরিফ কিনতু, নায়ক, নাগিব, মিঠু, দৃস্টি এদের সাথেও ছিল সুসম্পর্ক।
বাড়ির সব সামাজিক অনুষ্ঠানে জেঠা-জেঠীর উপস্থিতি অনুষ্ঠানে মর্যাদা বাড়িয়ে দিতো।
গত ২৫ জুন ওনার জানাজায় ওনার সহকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,কর্মচারী আত্মীয় স্বজন ঠান্ডা মিয়া চৌধুরীর পরিবারের সকল সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন মহামারীর এই কঠিন সময়েও। নির্বাক হয়ে ওনাকে কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করছেন। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সন্তান প্রফেসর মোহম্মদ আলী জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে থাকবেই পুরো জাতির মানসপটে। আর মহব্বত আলি মুন্সিবাড়ির ঠান্ডা মিয়া চৌধুরীর পরিবারসহ সবার হৃদয়ের মণিকোঠায়। আল্লাহ জ্ঞানের এ প্রিয় বাতিঘর জেঠাকে বেহেশতে সর্বোচ্চ মাকাম নসিব করুন।
মফিজুল হক চৌধুরী : মরহুম প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী’র ভাইপো।