দীর্ঘকবিতা


দারবিশ তুমি নেই।। মুজিব রাহমান।। পুবাকাশ


স্বপ্ন দুমড়েমুচড়ে গেছে কতো কতোবার
বিশ্বাসের ভূমি ওঠেছে কেঁপে কতো কতোবার
কে রাখে হিসেব!
পৃথিবীর হৃদয় আহা বারুদে ঠাসা,
মন নেই
মানুষ নেই, রারুদের গোলাম হয়ে বেঁচে আছে সব।
ইহুদি আছে, আরব আছে, বোমা আছে, পাথর আছে
দারবিশ, তুমি নেই!
তোমার কবিতা যাদের প্রাণবায়ু
তারা তোমাকেই খোঁজে তাঁবুর এদিক ওদিক!
ওদিকে আগুন-সন্ত্রাসীরা পুড়িয়ে দিয়েছে তোমার গ্রাম, তোমার বাড়ি। আরাফাতের প্রাণের বাড়িঘর আজ ধোঁয়ায়-কাঁকরে-বালিতে-বারুদে -রক্তে-মাংসে একাকার। হাহাকার প্রতিরোধ করছে কামানের গোলা আর বোমার বিমান! গাজায়, পশ্চিম তীরে, জেরুজালেমে, আকসায় সর্বত্র – আরাফাতের বসতি ঘিরে দানবের দাপট, দখলদারদের দোর্দণ্ড প্রতাপ!
আহা! তোমারই জন্মভিটায় তোমার কবর খুঁড়ছে খনকের দল। এক শতাব্দ ধরে তোমার নাম-নিশানা মুছে দিচ্ছে সভ্যতার ঠিকাদার
আর তাদের বশংবদ সকলে মিলে । আহা সভ্যতা! একেই কি বলে সভ্যতা!
বুঝি, ধ্বংসের স্মৃতিই তোমার তোমাদের একমাত্র স্মৃতি,
মৃত্যুর গন্ধ লেগে থাকে তোমাদের অবয়বজুড়ে, তোমাদের প্রতিটি রোমকূপে!
জন্মে উদ্বাস্তু তোমরা, মৃত্যুতেও। প্রতিটি তাঁবু একেকটি ব্যান্ডেজ হয়ে তোমাদের কপালে ঝুলছে। তোমাদের কোন সক্ষম স্বজন নেই। দেশে ও বিদেশে শুধু একটি স্বাধীন পতাকার স্বপ্নে, ভূ-খণ্ডের স্বপ্নে কীযে অধীর ও উন্মনা তোমরা! দেশে দেশে তোমাদের জন্যে কান্নাকাতর মানুষের অভাব নেই! অথচ মানবতা পায়ে পিষে
ইসরাইল আগুন দিয়েছে তোমাদের পথে
তেজষ্ক্রিয় ধোঁয়া দিয়েছে তোমাদের চোখে
তোমাদেরই রক্তে ভিজিয়ে দিয়েছে
তোমাদের মাটি ও মায়ের মুখ!
ফিলিস্তিন বলে কোন কিছু নেই। অস্তিত্ব নেই। কী অন্যায়, কী অন্যায্য কথা ধ্বনিত হয়েছিল গোল্ডা মায়ারের ঠাণ্ডা গলায়!
একই কথা এখনও ধ্বনিত হচ্ছে মার্কিনিদের অস্ত্রে
ব্রিটিশের মুখে নেতানিয়াহুর ট্রিগার-তৃপ্ত সুখে!
কামানের গোলায় জঙ্গি বিমান আর বোমা
ফিলিস্তিনিদের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে চায় প্রতি মুহূর্তে!

আহা দারবিশ, তোমার কবিতা যে মানচিত্র এঁকে দিয়েছে হৃদয়ে হৃদয়ে তা প্রতি মুহূর্তেই ছত্রখান!
যে স্যুটকেসে তুমি বহন করতে তোমার জন্মভূমি, সে স্যুটকেসটি লাপাত্তা – নিশ্চিহ্ন এখন!
জন্মদাত্রী ফিলিস্তিনের জন্যে বেঁচে থাকার
বিপুল স্বপ্ন প্রতি মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে! কী দেখছো তুমি কানিবক, জাতিসংঘ! তোমার এতো এতো পতাকা মিলে একটি পতাকার সম্মান আর মর্যাদা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে – এ তো তোমারই আত্মহনন!

আহা! মায়ের বানানো রুটি! বেলন-পিঁড়ি দুটোই গেছে! প্রতি মুহূর্তে জানের শঙ্কা!
যারা বলছে: সাকিন নেই, উদ্বাস্তু তুমি। মরু বালিতে ভরে যাক তাদের মুখ! তাদের চোখের আলো নিভে যাক সূর্যাস্তের আগে! হায়! একদিন তুমি যাদের আশ্রয় দিয়েছিলে তারাই আজ তোমার হর্তা! সব হরণ করছে তারা জান্তব ক্ষমতার আদিগন্ত নগ্ন অশ্লীলতায়! যে সভ্যতা অস্ত্রের, রক্তের, নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়ার সে সভ্যতা পাশবিক, জাঙ্গলিক! জঙ্গলের শান্তি আজ প্রার্থিত লোকালয়ে!
তাহলে কি এ সভ্যতা জাঙ্গলিক! মানবিক অর্জন বলে কি কিছু নেই! ক্ষমতা-ই শেষ কথা! মানুষের ভবিষ্যৎ যে মানুষ তারাও কি উধাও হয়ে গেছে, হয়ে গেছে বিলীন, নিশ্চিহ্ন!

বৃথা রেনেসাঁস, সভ্যতার গর্ব ইউরোপ!
অ্যামেরিকা গোড়াতেই রক্তপিপাসু! ব্রিটিশ তো গোড়াতেই ব্রিটিশ! আহা! বেচারা মধ্যপ্রাচ্য সেই কবে আত্মা বিক্রি করে মরুভূমিতেই ফেরারি তুমি!

গাজাকে বানাও তুমি পোড়া মাটি, কী অনির্ণেয় রাক্ষুসে ক্ষিধা তোমার, ইসরায়েল!
গাজা তো ফিলিস্তিন, যাদের রক্তের ঠিকানা অশেষ!
ইসরাইল,বৃটিশের আত্মার আত্মীয়, অ্যামেরিকার আত্মা, হিটলার তাড়ানো লাওয়ারিশ ইহুদির দল। ফিলিস্তিনি মহাত্মারা একদিন ঠাঁই দিয়েছিলো বলেই কি এতো কৃতঘ্নতা!
যাতনা দীর্ণ স্মৃতিতে ‘রাষ্ট্রনীতি’ ভেসে আসে:

‘কুড়াল কহিল, ভিক্ষা মাগি ওগো শাল,
হাতল নাহিকো, দাও একখানি ডাল।
ডাল নিয়ে হাতল প্রস্তুত হল যেই,
তারপরে ভিক্ষুকের চাওয়া-চিন্তা নেই –
একেবারে গোড়া ঘেঁষে লাগাইল কোপ,
শাল বেচারার হল আদি অন্ত লোপ।’
[ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

মাহমুদ দারবিশ নেই।এডোয়ার্ড সায়িদ নেই। তোমার যন্ত্রণার ভাগীদার সবাই একে একে চলে গেছে।
ফিলিস্তিন কন্যাটিকে বিয়ে করেছি এই শপথে পথ চলতে চলতে আযৌবন সংগ্রামী আরাফাত সেই কবে চলে গেছেন চির প্রস্থানের পথে! কী হবে তোমার ফিলিস্তিন!
নরক শূন্য করে সব শয়তান তোমার মাথার উপর তাধিন নাচবে আর কতোকাল! আর কতোকাল নিজভূমে পরবাসী থাকবে তুমি, ফিলিস্তিন!
দারবিশ তুমি ঠিক বলেছিলে –
ফিলিস্তিনিদের প্রতিটি আগামী আজকের চেয়ে ভয়াল! কোনই আগামী নেই, আছে বোমারু বিমান আর কামানের গোলা!
আহা দারবিশ! শোকে-সন্তাপে একদিন তুমি লিখেছিলে –
জলপাই গাছ যদি জানতো সে-হাতের ইতিবৃত্ত যে হাত লাগিয়েছিল তাদের তাহলে তাদের তেল বিষাদে অশ্রু হয়ে যেতো!

জলপাই-ডাল নেই, নেই কোন সবুজ কিশলয়
আকাশে বোমারু বিমান শিশুমনে আতঙ্ক ভয়!
এ কোন অজানা ভয়াল পৃথিবী অতিমারি কালে
ফিলিস্তিনি জান-মাল ছিন্নভিন্ন রোদেলা সকালে!
মানবতন্ত্রের সুবাতাস নিষিদ্ধ পৃথিবীর দেশ দেশে
ত্রাসের রাজত্ব চলছে গণতন্ত্রী ভুতুড়ে নির্দেশে!
মানুষের ভবিষ্যত ধোঁয়া হতে পারে না কখনো
অস্ত্রবাজ ইহুদিরা নষ্টভ্রষ্ট আহা তখনো এখনো!
অস্ত্রই শেষকথা যদি বাজ পড়ুক মাথায় তোমার
তোমার কাছে দাম আছে শুধু বিধ্বংসী বোমার!
উড়িয়ে দিতে পারো তুমি গুড়িয়ে দিচ্ছো সব
একদিন পৃথিবীও শুনেছিল তোমার আর্তরব!
আজ ঘৃণ্য তুমি, মারছো মানুষ চারদিক রক্তময়
ক্ষমতার ভাষা অস্ত্রের ভাষা মানুষের ভাষা নয়!
মানুষ জাগো মানুষের জন্যে মানুষই বরাভয়
অস্ত্রবাজের বিপরীতে মানুষেরই হবে জয়!

অত্যাচারী বীর নয় ভীরু, বাইডেন তুমি জানো
ইতিহাসের দায় তোমার কাঁধে আঘাত তুমি হানো।
ব্যর্থ হলে তোমাকেই বইতে হবে অত্যাচারের দায়
ঘৃণার আগুনে পুড়বে তুমিও, তুমিই দিয়েছো সায়!

আজ দুঃসময়ে রবি দূর দিগন্তে ভাসছে তোমার তরী
তোমার কবিতা শক্তির উৎস তোমার কবিতা স্মরি:

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’



মুজিব রাহমান: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন