ভার্চুয়াল সাহিত্যাঙ্গন

আবদুল কাইয়ুম মাসুদ

বই দেখেই কান্না জুড়ে দিলো রাসনা। মা জিজ্ঞেস করলো কি হলো? সে আঙ্গুল দিয়ে বই দেখিয়ে বললো, ‘এখানেও এটা’? তার মা বুঝে ওঠতে পারছিলো না। আবার জিজ্ঞেস করলো, এটা মানে? সে বললো, ‘নানু বাড়িতে প্রতিদিন এটা (এ বই) পড়ায়’। এতোক্ষণে মা বুঝেছে, সে কি বুঝাতে চাইছে।
রাসনা সম্পর্কে আমার ভাগনি। আমাদের বাড়িতে থাকে। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে আমার আম্মা নাতনীকে সাথে সাথে রাখে। তার সমবয়সী আমার ভাতিজিও আছে। তার নাম সুমাইয়া। দু’জনের বয়স ৪-৫ বছরের মাঝামাঝি । সুমাইয়ার মা অর্থাৎ আমার ভাবী সন্ধ্যার সময় কিছুক্ষণ পড়তে বসায়, দু’জনকে। বর্ণ, সংখ্যা এসব শেখায়। মাঝে মাঝে পড়তে না চাইলে একটু চাপও দেয়। উনাকে ভয় পায়। দু’জনেই পড়ে একসাথে। খুব একটা ডিস্টার্ব করে না।
রাসনাদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দূরে। আজ সে নানার বাড়ি থেকে মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছে। এখানেও তার কাজিন আছে, বেশ কয়েকজন। সবার সাথে ভালোই কাটিয়েছে সারাদিন। তার মা ভেবেছে সন্ধ্যায় পড়ার অভ্যাস যেহেতু আছে, একটু পড়ুক। তাই বই নিয়ে বসাতে চেয়েছে। বেড়াতে এসেও পড়তে হবে এটা কেমনে হয়? হয়তো সে ভেবেছে এখানে শুধু মজা আর মজা। তাই বই দেখামাত্র এমন কান্না। এটি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা।
আমি একজন শিক্ষক। কলেজে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় পড়াই। হয়তো সে কারণেই শিক্ষা বা জ্ঞান চর্চার বিষয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন হই। ভাবতে গিয়েই উপর্যুক্ত কথাটি মনে পড়লো। এসময়ে আমরা এরকম কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। শিক্ষায় প্রযুক্তির সংশ্লেষ হওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির সহায়তায় জ্ঞান চর্চা বা শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ এখন আমাদের সামনে। আমরা চাই এ সুযোগ কাজে লাগাতে। করোনাকালে এর সদ্ব্যাবহার সময়ের ন্যায্য দাবিতে পরিনত হয়েছে। কিন্তু এ প্রযুক্তির প্রয়োগ কিভাবে করবো? সে জায়গায়, আমার মনে হচ্ছে আমাদের সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
একদিকে আমাদের সুযোগ অবারিত করেছে প্রযুক্তি। এই যে আমি লেখার সুযোগ পেয়েছি; এ পেইজে অথবা আমার টাইমলাইনে। সেটি ফেসবুকে হোক বা টুইটারে হোক বা অন্য কোন ফ্লাটফর্মে হোক। প্রযুক্তির কল্যাণেই তা সম্ভব হচ্ছে। লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যরা পড়বে। যতবেশি পাঠক তত বেশি সার্থক; অন্তত সাহিত্য পাতার লেখার ক্ষেত্রে। স্মার্টফোন প্রায় সবার হাতে থাকায় পাঠকও নেহায়েত কম নয়। প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু পড়া বা দেখা হয়।
সদ্য প্রয়াত ইংরেজি সাহিত্যের স্বনামধন্য অধ্যাপক আমার প্রিয় শিক্ষক মোঃ গোলাম মোস্তফা স্যার কিছুদিন আগে একলাইনের স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘সবাই ফেসবুক তেলাওয়াত করছে’। আসলে আমরা তেলাওয়াত করি। এখানে ছবি, ভিডিও, অডিও, আর্ট, এনিমেশন, কার্টুন, জোকস, বাণি, খনার বচন, প্রবন্ধ, গল্প, সংবাদ, নাচ, গান, নাটক, সিনেমা, কবিতা আবৃতি, গ্রাফিক্স, এড ইত্যাদি থাকে। আবার সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতের উইশ থাকে। এসবের ওপর জম্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, মৃত্যদিন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দিবস উদযাপনতো আছেই। সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ, গুরুত্বপূর্ণ কার্যসম্পাদন বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে দেখা সাক্ষাতের সেল্পি, ছবি, ভিডিও অগ্রাধীকার ভিত্তিতে পোস্ট হয়। এসব কিছু্র সাথে আরও আকর্ষণীয় অনেক কিছু মিলে একইসাথে আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়; এসব ফ্লাটফর্মে। এসবের মধ্য থেকে সাহিত্যের বিষয়গুলো আস্তে আস্তে গুরুত্ব হারাচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। আমরা যারা গল্প উপন্যাস পড়ে বিনোদিত হতাম তাদের চোখও ছবি, ভিডিও ইত্যাদিতে আঁটকে যায়। নতুন জেনারেশনের কি অবস্থা আল্লাহ মালুম।
ভার্চুয়াল পরিবেশে বিনোদনের উপাদান এতো বেশি যে কোনো ব্যাক্তি অনেক অপশন থেকে প্রতি মুহূর্তেই অপেক্ষাকৃত পছন্দনীয় উপাদান বাছাই করে উপভোগের সুযোগ পায়, সহজে। অবসরে এখানে আসে মানুষ মজার কিছু দেখা, শোনা বা পড়ার জন্য। জ্ঞানগর্ব কিছু আর ভালো লাগে না। বলতে পারেন, একসময়েতো মানুষ বই পড়েছে, হ্যা পড়েছে তখন আর কোন অপসন ছিলো না তাই অবসরে এটাই বিনোদনের মাধ্যম হয়েছে। এখন অন্য অনেক কিছুর চাকচিক্যে সাহিত্য তার জৌলুষ হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় সাহিত্যকে বিনোদনের অপরাপর উপাদানের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখা যায় কিভাবে সেটি এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা প্রযুক্তির সহায়তা নিতে পারি।
সময়ের পরিক্রমায় সংবাদপত্র এখন ভিডিও প্রচার করে, রেডিওর সংবাদ পাঠকরা দৃশ্যমান হয়, টিভি লাইভ সংবাদ প্রচার করে। এভাবে খুঁজতে গেলে দেখা যায় পুঁজিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল কিছু প্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সেই তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রগুলো পিছিয়ে আছে। সাহিত্য চর্চার জন্য নতুন ফ্লাটফর্ম উন্নয়ন করা প্রয়োজন। যেখানে ইচ্ছেমতো লেখার শ্রী বর্ধন, ইলাস্ট্রেশন, অডিও, ভিডিও যুক্ত করার ব্যবস্থা থাকবে। কাব্য চর্চা রূপ লাবণ্যময় হবে। নতুন রূপ লাভ করবে এ অংগন। এটি হবে ভার্চুয়াল সাহিত্যাঙ্গন। এ সুযোগ আগে ছিলো না এখন আছে।
এখন আমরা বাস্তব ক্লাসের পরিবর্তে কৃত্রিম ক্লাস আপলোড দিচ্ছি। বইয়ের পরিবর্তে কতোগুলো লেখা পোস্ট দিচ্ছি। কেউ কেউ পড়ছে। বেশিরভাগই এড়িয়ে যাচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাহিত্য জগৎ বা জ্ঞান চর্চার অংগন। বাস্তবতা হচ্ছে, কৃত্রিম কখনো ন্যাচারালের সমান গ্রহণযোগ্যতা পায় না। বিনোদনের জায়গা ইন্টারনেটে বেড়াতে আসার পর সেই ক্লাস আর সেই কালো কালো লেখা পড়ার কথা বলা ঠিক রাসনার মায়ের কাছে বেড়াতে গিয়ে বই দেখে কান্না করার মতো।
আবদুল কাইয়ুম মাসুদ: আইসিটি প্রভাষক।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন