সিমলা থেকে মানালি ।। নাসির উদ্দিন আহমদ

দ্বিতীয় পর্ব…
সিমলা থেকে মানালি যেতে হবে। ড্রাইভার জানিয়েছে কমপক্ষে আট ঘন্টা সময় লাগবে মানালি পৌঁছতে। সেজন্য সাত-সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে হোটেল থেকে। সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই পাহাড়ী পথ পাড়ি দিতে পারলে ভালো। আমরা সাড়ে আটটার মাঝেই ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।

সিমলা-বিলাসপুর সড়ক দিয়ে চলছি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। ভেজা রাস্তা। খুব বেশী বাঁক—বলা যায় হাজার হাজার বাঁক—বাঁকের পরে বাঁক। দুদিক দিয়েই গাড়ি চলছে। বিপদজনক রাস্তা। রাস্তায় ভিড়। স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে ঘর থেকে। মাঝে মধ্যে ছোট খাটো যানজট। বৃষ্টি ভেজা ঝাউ গাছ। বৃষ্টি ভেজা লতা-গুল্ম-বন।আজ রাস্তা-প্রকৃতি-পাহাড় কাল বিকেলের চেয়ে আরো সুন্দর আরো মনোহর মনে হচ্ছে। বৃষ্টি ভেজা রমণীয় রূপ সত্যিই মনোমুগ্ধকর।আধা-অন্ধকার আধা-আলোয় বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ী অরণ্যের আঁকা বাঁকা রাস্তায় পথ চলা এক অন্য রকম থ্রিল। এই থ্রিলের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি। কিন্ত কারো কারো মাঝে থ্রিলের চেয়ে ভয়ের আধিক্য বেশী থাকে এমন রাস্তায়। কিছুদূর যেতে রাস্তায় চলমান মানুষের আনাগোনা কমে গেলো কিন্ত গাড়ির চলাচল কমলো না।বৃষ্টি ও ঝরছে অবিরাম—তার থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।বিলাসপুর থেকে মানালির দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে—আরেকটি চলে গেছে দিল্লীর দিকে। এখান থেকে চন্ডিগড়ের পথেও যাওয়া যাবে। বিলাসপুর যেন এক জংশন।

পথে পড়বে সুন্দরনগর—বিস্তীর্ণ এক মালভূমির ওপর শহর। আমরা শহরের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। বাড়িঘর মানুষ প্রকৃতি সবই সুন্দর। বিশাল বাজারের মাঝ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। সব ধরণের জিনিসপত্রই রয়েছে বাজার জুড়ে। বিভিন্ন মোবাইলের শো-রুম, সনি শো-রুম, উডল্যান্ড জুতার দোকান, হোটেল রেঁস্তোরা, কাঁচা সব্জীর পসার সব রাস্তার পাশে। বাস ট্রাক স্ট্যান্ড গাড়ি মেরামতের অসংখ্য ম্যাকানিক শপ, কার ওয়াশ টায়ারের দোকান কি নেই? আছে শহরের প্রতীক—ডাস্টবিন। শীত যে ভয়ানক তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই বেলা বারোটায় রাস্তার পাশে অনেক দোকানের সামনে আগুন জ্বালিয়ে যুবক বৃদ্ধ তাপ পোহাচ্ছে।

আমাদের চলার পথে যোগ দিয়েছিলো এক নদী—সূতলেজ নদী। এই নদী এই শহরে ঢুকে গায়ে পরেছে ইট-পাথরের পোশাক। পাহাড়ী নদী শহরে এসে পাড় বাঁধানো রূপ ধারণ করে উছলানো সৌন্দর্য নিয়ে ডেকে ডেকে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দর্শনার্থীদের। নদীতে টলটলে ঈষৎ নীলাভ জলরাশি। লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে নদীর পানিতে।

সুন্দরনগর থেকে মান্ডি যেতে যেতে চোখে পড়বে সবুজ ফসলের ক্ষেত। ধান গম যব সব্জীর ছোট বড় সবুজ ফসলের বাহার। পাহাড়ের মধ্যবর্তী এমন সমভূমি সচরাচর চোখে পড়ে না। যেখানে এমন সমভূমি আছে সেখানেই চাষ-বাসের জন্য ভূমির সদ্ব্যবহার করা হয়েছে। পাহাড়ের মাঝে নদী। নদীর পাড় ঘেঁষে উঁচু দালান কোঠা। মান্ডি দেখে শুনে মনে হচ্ছে উন্নত শহর। যতই দেখছি ভালো লাগছে এই শহর। বড় বড় মন্দির গুরু দুয়ারা শহরে। নদী সঙ্গ দিচ্ছে সারাটি পথ। নদীর বুক ভর্তি পাথর —স্রোত আছে ক্ষীণ—পানি কম।মার্চ এপ্রিলে পাহাড়ের বরফ গলতে শুরু করবে তখন এই নদী হবে ভরা-যৌবনা। রাফটিং হবে নদীতে। এখনো হয়। মাঝে মাঝে নদীর জলাধার আটক করা হয়েছে স্লুইজ গেটের মাধ্যমে। আটকে রাখা বাঁধের উজানে থৈ থৈ পানি।

এখানে পথ চলতে ভালো লাগবে মেঘ। এখানে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে মেঘ। বেড়াতে যাচ্ছে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের কোলে। আমরাও মাঝে মাঝে যাচ্ছি মেঘের ভিতর দিয়ে। মেঘের ঘরবাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে গাড়ি। দৌড়ে পালাচ্ছে মেঘ আমাদের ছেড়ে। মেঘ আর আমাদের লুকোচুরি। এ যে মেঘের রাজ্য। আমরা সেখানে নিমেষের অতিথী। তবে মেঘের ভিতর আমার বিচরণ নূতন নয়। একসময় বান্দবানের চিম্বুক ক্যাম্পে কাটিয়েছি এক বছরের বেশী সময়কাল। তখন মেঘের ভিতর দিয়ে বিকেলে মাঝেমধ্যে দৌড়াতাম। আমার রুমের পশ্চিমের জানালা খুলে দিলে ঢুকে যেত মেঘ। মেঘের সাথে আমার তখন কুটুমের সম্পর্ক। আমাদের আরেকটি ক্যাম্প ছিলো নীলগীরি। সেখানে অফিসার্স মেস ছিলো। সাধারণত সেখানে আমরা কেউ থাকতাম না। থাকতাম চিম্বুকের বেইস ক্যাম্পে। তবে আমি মাঝে মধ্যেই একাকী জোছনা রাত আর মেঘের আতিথেয়তা গ্রহণের জন্য নীলগীরিতে রাত্রি যাপন করতাম। সেই মেঘ এখন সিমলা মানালির পথে। মেঘের ভিতর ডুবে যেতে যেতে চিম্বুকের স্মৃতি যেন উড়ে আসছে মেঘের সাথে সাথে।

পাহাড় মেঘ গীরিখাত পাথর নদী ঘন বৃক্ষের সারি সব পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি মান্ডি থেকে কুলু। দুই পাশে বিশাল উঁচু পাথুরে পাহাড়—রকি মাউন্টেইন। নিচে সেই নদী—এখন নদীর নাম বদলে গেছে। বীজ নদী। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদী। হিমাচল প্রদেশের মধ্য-ভাগে নদীটির উদ্ভব।চারশত সত্তর কিলোমিটার বয়ে চলার পর এটি মিলিত হয়েছে সূতলেজ নদীর সাথে। এই নদীই ছিলো গ্রীক বীর মহান আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের সর্বশেষ সীমানা। ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায় এই নদী তীরে এসেই তাঁর বাহিনী সাহস হারিয়ে ফেলে। খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে এই নদী তীরে তাঁর বাহিনী সামনে না এগুনোর জন্য বিদ্রোহ করে। শেষমেষ আলেকজান্ডার ভারত বিজয়ের আশাবাদ ত্যাগ করে ফেরত যেতে বাধ্য হন। আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে সেই নদী। কখনো রাস্তার ডানে কখনো বামে। আমরাও মাঝে মাঝে ব্রীজে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি এপার-ওপার। আর নদীটি যেন আমাদের সঙ্গ দিতে তার স্রোত সাথে নিয়ে বড় বড় উপল খন্ডের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন ছন্দে।

রাস্তা কিন্ত মাঝে মধ্যেই খুব ভয়ংকর। পাহাড় কেটে নির্মিত রাস্তা। শক্ত পাথর কোথাও এমন ভাবে কাটা হয়েছে যে ট্রাকের উপরের ছাদ যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের পাথর।মাঝে মাঝে ছোট ঝর্ণা নজরে পড়ছে। হালকা বৃষ্টির কারণে রাস্তা কর্দমাক্ত কিছুটা পিচ্ছিল। কয়েক কিলোমিটার রাস্তা ভাঙাচুরা। সংস্কার কাজ চলছে। কোথাও চলছে সুরঙ্গ পথ ফ্লাই ওভার করার নির্মান যজ্ঞ। এখানেই হিমাচল প্রদেশের ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। ভয়ের কারণে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছি না।রাস্তার পাশে পাহাড়ের ঢালে টন টন ওজোনের বড় বড় শ্বেত আর কৃষ্ণ পাথর। যদি গড়িয়ে নিচে নেমে আসে তবে তো রক্ষে নেই!
কাদার কারণে চলমান গাড়ির দিকে তাকানো যাচ্ছে না—বিশ্রী রকমভাবে কর্দমাক্ত। লেপ্টানো কাদা লুকিং গ্লাসেও আশ্রয় নিয়েছে। এখানেই হঠাৎ বড় এক ট্রাকের ধাবমান চাকার ঘন কাদা-পানি আমাদের ট্যাক্সির সামনের কাঁচের উপর আছরে পড়লো। হঠাৎ সামনের দৃষ্টি বন্ধ। ভাগ্যিস সামনে আগত গাড়িটি ব্রেক করেছিলো নইতো বিপদ ভয়াল রূপ নিয়ে ধেয়ে আসতে পারত। থ্যাংকস টু আল্লাহ।….

কুলু এখানকার জেলা শহর। মানালি এই জেলার এক অংশ। মানালি আর লারগির মাঝখানে তিন পাহাড়ের ঢেউয়ে যেন স্যান্ডউইচ হয়ে আছে কুলু। এই তিন পাহাড় হলো গ্রেট হিমালয়, লোয়ার হিমালয় আর পীর পান্জেল। কুলু নামটি এসেছে “কুলান্ত পিঠ” শব্দ থেকে। এর অর্থ সর্বশেষ মনুষ্য বসতি।কথিত আছে বিশ্ব প্লাবনের পর মনু এই উপত্যকায় আসেন এবং রোথাং পাস এসে আর অগ্রসর হতে পারেন নি। এবং তখন এর নাম দেন কুলান্ত পিঠ। সেই থেকে কুলু নামটি এসেছে। আর মনু এখানে গড়ে তোলেন বসতি। সেই থেকেই এটি মনুর স্থান যা মানালি রূপ পরিগ্রহণ করেছে। এখানে পাহাড়ে পাইন আর দারুবৃক্ষের বন। আপেল বাগান চোখে পড়বে পথ চলতে চলতে। পাতা ঝরে গাছগুলো এখন ন্যাড়া হয়ে আছে। রুগ্ন চেহারার এই আপেল বাগান দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। মন চায় ফলবান যৌবনা আপেল বাগান।
ইংরেজরা সর্বপ্রথম মানালিতে গড়ে তোলে আপেল বাগান। সেই থেকে এই এলাকায় আপেলের চাষ শুরু। আপেল ছাড়াও নাশপাতির চাষও শুরু হয় তখন থেকে। আরো আছে কূল আখরোট আর নানা জাতের বাদাম। রঙিন তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের আচ্ছাদন পাহাড়ের গায়ে গায়ে।কোথাও বাদামী কোথাও লাল। রঙিন পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বৃক্ষ।। কাকা ফলও আছে এখানে। এই ফলটির সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে কুয়েতে থাকাকালীন সময়ে। মিশর থেকে আসতো ফলটি। আমার খাওয়া সবচেয়ে মিষ্টি ফল এই কাকা। পাকা টমেটোর মতো ফাটাফাটি রং আর ভিতরে বাংলা গাবের মতো নরম কোয়া। আকৃতি বড় টমেটোর মতো।ভারতে এই ফলটির অন্য এক নাম আছে। এ মুহূর্তে হিন্দী নামটি মনে আসছে না। তবে ভারতে প্রথম যখন ফলটি কিনতে গেলাম তখন বিক্রেতা খুব ভক্তি গদগদ হয়ে বলেছিলো ফলটি নাকি রামের খুব পছন্দের ছিলো। তবে মিশরের কাকা ফলের স্বাদ ঢের ভালো। সেই কাকা ফলের বাগান এই কুলু মানালি জুড়েই।রাফটিং করার জন্য অসংখ্য বুকিং কর্ণার আছে পথে পথে। বৃষ্টি চলছেই সাথে শৈত্য।রাফটিং করার ইচ্ছা তাই কবর দেয়া হলো।
কুলুর শাল বিখ্যাত। কাশ্মিরী শালের পরেই কুলুর শাল আর চাদরের নামডাক। পথে পথে শাল-চাদর-উলেন পোষাকের দোকান, শো-রুম। নিচে তাঁতীরা তৈরী করছে শাল আর দোতলায় খোলা হয়েছে বিপণী কেন্দ্র। আমরা একটি দোকানে থামলাম। তখনো বাইরে দাপিয়ে চলছে বৃষ্টি।

মানালির কাছাকাছি পৌঁছতেই গাড়ি থেকে দেখা মিললো বরফের। পাহাড়ের চূড়ায় স্তরে স্তরে বরফের আচ্ছাদন। মনের মাঝে অন্য রকম আনন্দ আবেশ। আমরা ছবি তুলছি চলন্ত গাড়ি থেকেই। ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে—ছবি নেয়ার জন্য। ড্রাইভার নির্বিকার জবাব দিলো—কত বরফ দেখবেন স্যার; বরফের ওখানেই তো যাচ্ছি। গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা হলো না। তবে কিয়ৎ সময় যেতেই বুঝলাম—সত্যিই বরফের রাজ্যে যাচ্ছি। যে গাড়িগুলো মানালির দিক থেকে আসছে সেগুলোর ছাদে বরফ জমে আছে—বরফ জমে আছে সামনের গ্লাসে। মনের ভিতর তখন বরফ দেখার শিহরণ। দুয়েক কিলোমিটার পথ চলতে তো আরো অবাক হওয়ার পালা। রাস্তার দুপাশে পার্ক করা গাড়িতে বরফের স্তর। রাস্তার পাশে জমে আছে বরফ, ঘরের ছাদে বরফ। মটর সাইকেল ডুবে আছে যেন বরফে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে লবণের স্তূপ। ছোট বেলায় লবণ হাটে দেখতাম লবণের স্তূপ। এখন রাস্তার পাশে পাথরের উপর বরফ পড়ে মনে হচ্ছে লবণ হাটের সেই স্তূপ।

আমাদের হোটেল বুকিং দেয়া হয়েছে স্নোক্রেস্ট মানোরে। আমরা শহরে ঢুকে সেদিকেই যাচ্ছি। মূল রাস্তা ছেড়ে গাড়ি উঠে যাচ্ছে এখানকার মাল রোডে। উপরে উঠছি। বৃষ্টি হঠাৎ রূপ নিলো তুষারপাতে। বরফ পড়ছে আকাশ থেকে রাশি রাশি—মনে হচ্ছে তুলার ছোট ছোট বল। বরই বীচির আকৃতির হালকা বরফের রাশি রাশি প্রপাত। উপর থেকে নিচে পড়তে পড়তে আকৃতিতে একটু বড় হয়ে যাচ্ছে আর বেসামাল ভাবে ঝরে পড়ছে মাটিতে।পাশ দিয়ে এক পাল গাধা চলছে সামান বোঝায়। গাধার পিঠে বরফের সামান। এখানে রাস্তার দুই পাশে ঝাউ গাছের পাতায় পাতায় বরফ। খুব সুন্দর লাগছে স্তরে স্তরে সাজানো ঝাউ পাতার বরফ। ক্রিসমাস ট্রি জুড়ে থরে থরে সাজানো বরফের আয়োজন। আমরা আরো উঁচুতে উঠছি। আর মাত্র তিন মিনিটের পথ আমাদের হোটেল। ড্রাইভার বললো—স্যার আর উপরে গাড়ি নিতে পারব না। ঝুঁকি আছে। রাস্তায় চাকার ঘর্ষণে বরফ জমতে পারছে না তবে দুপাশেই কয়েক সেন্টিমিটার বরফের জমাট স্তর। আমার স্ত্রী এমনিতেই ভয়ে কাঁপছিলো এই পাহাড়ী বরফাচ্ছাদিত রাস্তা দেখে। হঠাৎ তার ভয় আরো দ্বিগুন হয়ে গেলো ড্রাইভারের কথায়। এই হোটেলের রাস্তায় কিছুতেই উঠবে না চালক। শেষমেষ ইউ টার্ণ। গাড়ি ঘুরিয়ে বুকিং করা হোটেল বাদ দিয়ে অন্য হোটেলের পানে যাত্রা।

উপরের হোটেল থেকে বরফ ভালো দেখা যাবে—নিচে গেলে এত সুন্দর নাও দেখা যেতে পারে—সেজন্য মেজাজ খারাপ। এই খারাপ মেজাজের ভিতর যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো তুষারপাত। তুষার উপেক্ষা করেই নেমে পড়লাম আরেক হোটেলের সামনে। গাড়ি থেকে নামতেই জ্যাকেটের গায়ে মাথায় ঝমঝমিয়ে পড়তে থাকলো তুষার-বল। দারুণ এক অভিজ্ঞতা। তুষার-বল কিন্ত আলতোভাবে গায়ে পড়ে।কিছুক্ষণ লেগে থাকে পোশাকে তারপর গলে যায়। সেভিং ফোমের চেয়ে কিছু ভারী তবে রঙে ঢঙে বলা যায় সেভিং ফোমের মতোই।…

রুমে এলাম। বরফ জমেছে পাহাড়ে-পাহাড়ে, পাথরে, রাস্তায়, গাড়ির কাঁচে, ছাদে। বরফে চারিদিক শুভ্র সাদা। এই সাদা তুষার দেখে ডিসেম্বরে সান্তাক্রুজের পক্ক শশ্রুমন্ডলের কথা মনে পড়ছে। তাঁর দাড়ির মতো শাদা তুষার। মনে হচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো সাদা তুষার। তুষার যেন তুলোর বলের উপমায় উড়ে আসছে আকাশ থেকে।গাছের পাতায় পাতায় শাখায় শাখায় জমে গেছে বরফের চুমু।

এই বরফের ভিতর চারিদিকে শূণ্য ডিগ্রীর নিচে তাপমাত্রা। গাড়ির চলাচল কমে গেছে। তাই বের হলাম না সন্ধ্যায়। রুমের জানালা খুলে উপভোগ করতে থাকলাম—তুষারপাত।

সকালে উঠে দেখি চারিদিকে শুধু সাদা আর সাদা। পাশের ছাদের বরফ আধা ফুটের চেয়ে বেশী পুরু। রাস্তা ঢেকে আছে বরফে। গাড়ি চলাচল বন্ধ। লনে পুরু বরফের আস্তরণ। এই বরফের উপর দিয়েই দেশী কুকুর হেঁটে যাচ্ছে খালি পায়ে আর বরফের ভিতর নাক ডুবিয়ে খুঁজে যাচ্ছে খাবার। পাখিগুলো উড়ছে এই বরফের মাঝেই। এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে যাচ্ছে আর ঝপঝপ করে ডাল থেকে ঝরছে বরফ। আমাদের চিরপরিচিত কাক পাইন গাছের বরফের ডালে বসে কা কা করছে। আমাদের পরিচিত কবুতর দারুবৃক্ষের ডালে বসছে। তার হালকা ভারে ডাল থেকে ঝপাৎ করেই পড়ে যাচ্ছে পাতায় জমে থাকা শুভ্র বরফ। বরফে এমনকি হেঁটে বেড়াচ্ছে দেশী মুরগী।

দশটায় বাইরে বেরুনোর কথা। ড্রাইভার জানালো উপরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। বরফের মাঝে ঘুরে বেড়ানো কিংবা স্কেটিং করার জন্য বেলা একটার আগে বেরুনো যাবে না। কারণ রাস্তার বরফ এখনো পরিষ্কারের কাজ চলছে। রোদ ওঠেনি—বাইরে গাড়ি নিয়ে ঘুরা ঝুঁকিপূর্ণ। গাড়ির চাকা হড়কে যেতে পারে। সুতরাং রুমের মাঝে অলস বসে থাকা আর সাদা বরফের সৌন্দর্য চোখে মেখে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করা যাচ্ছে না। তবু আনন্দ—বরফ দেখার আনন্দ।

একটার সময় ড্রাইভার জানালো—স্যার এখন বাইরে যাওয়া যাবে। আমরা কানটুপী, হাত-মোজা, মোটা জ্যাকেট গায়ে চেপে নিচে নামলাম। হোটেলের পুরো লন জুড়েই বরফ। হোটেলের রাস্তায় শুধু গাড়ি চলাচলের জায়গাটুকু বরফ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাকী সবটুকু জুড়েই বরফের স্তর।
রোদ উঠছে ফের নিভে যাচ্ছে। বরফের উপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। পাহাড় চূড়ায় বরফের উপর ঝিলিক পড়া রোদের রূপ সত্যিই অদ্ভূত। কিছুদূর যেতেই দেখি বিশাল জট। বরফে গাড়ি ফেঁসে গেছে। অনেক চেষ্টার পর জট খুললো। বীজ নদীর স্রোত কালকের চেয়ে আজ ধারালো হয়েছে। কিছু বরফ গলে মিশে যাচ্ছে স্রোতে। ফলে নদী ফিরে পেয়েছে খানিক যৌবন। নদীর পাড় জুড়েই ছোট বড় পাথর। পাথরগুলো যেন বরফের কানটুপী পরে আছে। সারি সারি বরফের কানটুপী পরা উপলখন্ডের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শীতল ধারার নদী। আর সারিবদ্ধ এমন সাদা বরফে আচ্ছাদিত পাথর মনে হচ্ছে নদী পাড় জুড়ে ছড়ানো অজস্র বড় বড় মণি-মুক্তোর মেলা। নদীর পাড়ে মাঝে মধ্যেই স্কেটিং করার ব্যাবস্থা রয়েছে।পথে পথেই দোকান। বরফের ভিতর হেসে খেলে বেড়ানোর জন্য পোষাক। একদিনের জন্য বিশেষ এই পোষাক ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।বরফ পড়লে দোকানীদের ব্যবসা জমজমাট।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ বরফের মাঝে হেঁটে বেড়ালাম। বৃষ্টি শুরু হলো। দুপুরের খাবার তখনো খাওয়া হয়নি। বরফ পেরিয়ে এক হোটেলের বুফেতে যোগ দিলাম।

হোটেলে স্ত্রী কন্যা রেখে হালকা বৃষ্টি মাথায় করেই একাকী হাঁটতে বেরুলাম—শৈত্য উপভোগের জন্য।দু-মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মাল রোডে।এই বরফের মাঝে নানা সদাই-পসার নিয়ে বসে আছে দোকানীরা। খোলা বিক্রেতাও রয়েছে। আখরোট, কাজুবাদাম, আরো বিভিন্ন জাতের বাদাম, কিশমিশ, শুকনো আপেল বিক্রী করছে তারা। বাদাম ভেজে গরম গরম বিক্রী হচ্ছে। গরম গরম কোয়েল পাখির ডিমের মতো ছোট মিষ্টি বিক্রী হচ্ছে পথে পথে। নাম গোলাপ জাম। পনেরোটা মিষ্টি ত্রিশ রুপী। অল্প ক্ষণ এভাবে ঘোরাঘুরি করে ঠান্ডায় জমে যাবার জো। তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম হোটেলে।

রাত পাড়ি দিয়ে ফের সকালেই ফিরে যাব দিল্লীর পানে। যেতে সময় লাগবে তেরো চৌদ্দ ঘন্টা। ভাবছি রবিবার যেহেতু বন্ধের দিন সুতরাং এত দীর্ঘ ভ্রমণ না করে বরং চন্ডীগড়ে যাত্রা বিরতি করব। রোববার সকালে চন্ডিগড়ে ঢু মেরে ধীরে সুস্থ্যে আপন ডেরায় ফিরে যাব।

নাসির উদ্দিন আহমদ: কবি ও প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪টি। সামরিক বাহিনীর চিকিৎসা বিভাগে কর্তব্যরত।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন