পুনঃপাঠ।। জন্মদিন স্মরণে
শুরুর দিনগুলাে
আবদুল মান্নান সৈয়দ।। পুবাকাশ
[ আজ সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ এর ৭৮ তম জন্মবার্ষিকী। জন্ম ৩ আগস্ট ১৯৪৩, মৃত্যু ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০। কবিতা কথাসাহিত্যের পাশাপাশি গবেষণার কত দিগন্ত না তিনি উন্মোচন করেছিলেন। মাইকেল থেকে শহীদুল জহির- আলো ফেলেছেন মননশীল উৎসুক ও ধীমান প্রজ্ঞায়। তাঁর আত্মাকথামালায় এ ধীমানকে স্মরণ করছে পুবাকাশ ওয়েবম্যাগ। সম্পাদক ]
আমি অনেক পেয়েছি।
আমি কিছুই পাইনি।।
পঞ্চাশের মন্বন্তর। আজকের নতুন প্রজন্মের অনেকে হয়তাে জানেই না। বা শুনলেও ঠিক বােঝে না, ব্যাপারটা কি। বিষয়টা হচ্ছে এই। – চতুর্দশ বঙ্গাব্দের একশাে বছরের মধ্যে সবচেয়ে কালাে বছরটি হচ্ছে ১৩৫০। ইংরেজি হিশেবে হবে ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দ। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। সেই সময় এমন-এক মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ হলাে বাংলায়, যার কবলে পড়ে লাখ লাখ লােক পথে-ঘাটে মারা যায়।
জয়নুল আবেদিন এদের ছবি এঁকেই চিরকালের জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন। কবি ফররুখ আহমদ এদের নিয়েই তার লাশ’ ও অন্যান্য অনেক মর্মস্পর্শী ও প্রতিবাদী
কবিতা লিখেছিলেন। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই মন্বন্তরের কবিতা নিয়েই তার ছােট্ট কিন্তু অসামান্য আকাল বইটি সম্পাদনা করেছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত
একমাত্র গ্রন্থ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ আজ-কাল-পরশুর গল্প নামের গল্পগ্রন্থটি এই দুর্ভিক্ষেরই ফসল। লিখেছিলেন, ছবি এঁকেছিলেন, গান লিখে ও গেয়ে আরাে অনেক শিল্পী এই মর্মান্তিক বছরটিতে তাদের মানবপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। এই ১৩৫০-এর ১৮ই শ্রাবণে আমার জন্ম। ইছামতি নদী থেকে ঈষদূর এক গাছপালাভরা গহীন গ্রামে। গ্রামের নাম জালালপুর।
পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান আমি। এই চতুর্থ সন্তান নিয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি কবিতা আছে। সেখানে তিনি এদের জন্যে খেদ-ক্ষোভ-বেদনা প্রকাশ করেছেন। আমার জন্মের পর আমার এক দাদি (তিনি আমার এতিম আব্বাকে মানুষ করেছেন) লােকমুখে শােনেন মেয়ে হয়েছে। সেজন্যে তিনি আর দেখতে আসেননি। কয়েকদিন পর দেখতে আসেন আমি পুত্র শুনে। সেকালের মহিলাদের, হয়তাে এখনাে, পুত্রসন্তানের প্রতি দুর্বলতা ছিল, বা আছে। যাই হােক, আমার ওই দাদির তখন অনেক বয়েস। আমাকে দেখার পর কাছেই ওঁদের বাড়িতে ফিরে যাবার সময় দাদি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। কয়েকদিন পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।
কোনােদিন আম্মা আমাকে বলেননি, কিন্তু তাঁর বড় মামাকে (সৈয়দ মেহের আলী) একদিন এমন-এক কথা আম্মা বলেছিলেন, যা আমি কখনাে ভুলিনি।
জন্মদিন উপলক্ষে আবদুল মান্নান সৈয়দ এর কবিতা ২০০৫
আড়াল থেকে কথাটি কিভাবে যেন কানে গিয়েছিল আমার। আমার জন্ম হয়েছিল। সােমবার ভরে। সেই রাতে আম্মা একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি ভােলেননি কখনাে, অন্তত তখন পর্যন্ত। আম্মা তার মামাকে এই স্বপ্নের গূঢ় কোনাে। অর্থ আছে কি না জিগেস করেছিলেন। বড় নানা সে বিষয়ে কি জবাব দিয়েছিলেন,
তা আমি শুনতে পাইনি। আমি হয়তাে আরাে আড়ালে চলে গিয়েছিলাম ।
আমি সেই দুর্বৎসরের সন্তান। আমি সেই দুঃস্বপ্নের পুত্র। আমার জন্ম হয়েছিল নানাবাড়িতে। আমি ছিলাম নানা-নানির সবচেয়ে আদরের নাতি। আব্বা সরকারি চাকরি করতেন। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর আব্বা অপশন দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন। আমি থেকে গিয়েছিলাম গ্রামেই।
তখনাে পাসপাের্ট-ভিসা চালু হয়নি। আম্মা মাঝে মাঝেই আমার বড় ভাইবােনদের নিয়ে ঢাকায় আসতেন, আবার গ্রামের বাড়িতেও ফিরে যেতেন। ১৯৪৬-এর কলকাতার স্টেটসম্যান-কথিত ‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে হিন্দু-মুসলমান অনেকে খুন হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের সেরা দুই কবি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ততদিনে মর্তবন্ধন ছিন্ন করেছেন ও নির্বাক হয়ে গেছেন বেঁচে আছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি তাঁর অসামান্য ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায় এই সময়ের সাক্ষ্য ধরে রেখেছেন। কিন্তু ১৯৪৬এর পরে হিন্দু-মুসলমান ভয়াবহ যে-দাঙ্গা হয়েছিল, তার কথা শুনি না তেমন। ১৯৫০ সালে আরেকটি বড় দাঙ্গা হয়েছিল। এই ১৯৫০ সালেই একটি নৌকোয় আমরা আমাদের জন্মভূমি চিরকালের মতাে ছেড়ে আসি।
সেই দিনটির কথা আমি কোনােদিন ভুলতে পারিনি। আমার নানা-নানি, আম্মা, ভাইবােনরা দুপুরে খেয়েদেয়ে গরুর গাড়িতে রওনা হয়েছিলাম। নৌকো ইছামতি নদীর তীরে আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়।
সুন্দর নির্জন বিকেলের পড়ে-আসা রােদের কথা মনে আছে। একটু পরেই সন্ধে ঘনিয়ে আসে। সন্ধেবেলা নৌকো ছাড়ে। নদীতে বেশ অন্ধকার ছিল। বােধহয় অন্ধকার রাত হিশেব করেই আমাদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। নৌকো এগােচ্ছে ছপছপ করে, অনেকক্ষণ হয়ে গেল, ততক্ষণে পৌছে যাওয়ার কথা, কেননা ওপারে এক দেশ – এপারে আরেক দেশ, হঠাৎ বড় ভাই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমরা-না অনেকক্ষণ আগে এখানে দিয়েই গিয়েছিলাম। মাঝি বলল, “আমরাও
তাই ভাবছিলাম। এতক্ষণ তাে পৌছে যাবার কথা। আসলে নদীতে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের রক্তের ভেতরে তখন হিম শিরশিরানি। নৌকো এগিয়ে যাচ্ছিল। আর-এক জায়গায় এসে মাঝি আমাদের বলল, ছইয়ের ভেতরে চলে যেতে। জায়গাটার নাম ‘আল্লারাখার চর’। অর্থাৎ ডাকাতদের চর। আমরা তাড়াতাড়ি ছইয়ের ভেতরে চলে গেলাম। বেশ রাতে আমরা দেবহাটায় পৌছলাম।
ওখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম আমরা। আমরা তখন এত ছােট ।
কিছু বােঝার বয়েস হয়নি, ভয়ের মধ্যে এক ধরনের আনন্দও পেয়েছিলাম, এক ধরনের এ্যাডভেঞ্চারের আনন্দ। তখন পর্যন্ত আমি কোনােদিন গ্রামের বাইরে যাইনি। নৌকোও চড়িনি।
ওই দুটি সাল আমার মনে চিরকালের মতাে গেঁথে আছে। বাংলা ১৩৫০ সাল আর ইংরেজি ১৯৫০ সাল। দু’টিরই মূলে জন্মভূমি হারানাের বেদনা। আমার সমস্ত জীবনের ও সাহিত্যের মর্মে মর্মে এই রক্তবিদারণরেখা জমে আছে। আমি- যে জীবনভাের বিষন্নতায় ভুগি, ব্যর্থতাবােধে অবিশ্রাম আক্রান্ত, তার মূলে আছে ওই বােধ। জীবনে-যে কিছু করতে পারিনি, সুখী হতে পারিনি, বিরামহীন শূন্যতায় ভুগি, আর ওই শূন্যতা ভরাতে অবিরল গদ্য-পদ্য লিখি – সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে ওই বেদনা।
দুর্ভাগ্য আমাকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরেছে। তার জন্যে যেটুকু পেয়েছি, সেটা মনে করি আল্লাহতালার অপার রহমত।
গভীরভাবে নির্জন ও অসামাজিক মানুষ আমি। অনেকের সঙ্গে পরিচিত আমি, আমার অনেক বন্ধু আছে, কিন্তু কেউ আমার অন্তরাত্মার সন্ধান পায়নি। সেজন্যে সবসময় নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। অনেকে ভাবেন আমি লেখায় এত অভিনিবেশী কেন ও কিভাবে? সােজা ব্যাখ্যা এই—এজন্যে যে, আমাকে ভুলে থাকতে হয়। এই এখন রােগশয্যায় শুয়ে শুয়ে একটি ব্যর্থ জীবন-নাট্যের যে-আলেখ্য আঁকলাম কয়েকটি মাত্র আঁচড়ে, সেও তাে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে। অন্য কিছু নয়। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমাদের বাংলার শিক্ষক তসলিমউদ্দিন আহমদ আমার বাংলার খাতা দেখে ভবিষ্যদ্বাণীর মতাে করে বলেছিলেন, এই ছেলে একদিন লেখক হবে। ওই একই সময়ে বাংলারই শিক্ষক ওদুদ স্যার আমার বাংলার আরেকটি খাতা দেখে এমন রূঢ় মন্তব্য করেছিলেন যে, আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার সারা সাহিত্য-জীবনে এর অনুবৃত্তি হয়েছে।
একদিকে অকল্পনীয় প্রশংসা শুনেছি, অন্যদিকে পেয়েছি অভাবনীয় অপমান। আমার প্রথম আত্মপ্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। লেখক হিশেবে এই বয়েসেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি, বিতর্কিতই রয়ে গেলাম। অগ্রজ-অনুজ-সমসাময়িক লেখকদের অঢেল প্রশংসা যেমন পেয়েছি, তেম্নি পেয়েছি অবিরল বিরুদ্ধতা। কাজী নজরুল ইসলামের পরে আর-কোনাে বাঙালি-মুসলমান লেখককে এত আঘাত সহ্য করতে হয়নি। একসময় একটি পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিনই বলব বেরিয়েছিল, যার প্রত্যেকটি সংখ্যায় লেখা হতাে আমার বিরুদ্ধে। পত্রিকাটি অবশ্য টেকেনি বেশিদিন। একাধারে ইসলামি, অবক্ষয়ী, অশ্লীল, ব্যক্তিবাদী, যৌনতাবাদী, শূন্যবাদী, বাস্তবতাবর্জিত, সুররিয়ালিস্ট, অসামাজিক, জীবনবিরোধী- কত রকম অভিধাই-না পেয়েছি আমি। তবে আমার অন্তর্লোক এসবের দ্বারা একফোটা বিচলিত হয়নি। আমি আমার বিশ্বাসে অনড় থেকেছি। আমার অন্তর্গত সন্ধান কখনাে বন্ধ হয়নি। যেমন বন্ধ হয়নি আমার সৃষ্টিশীলতা।
একই সঙ্গে ভাগ্যের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এজন্যে যে, পরস্পরবিরােধী মতাদর্শের পত্রিকা-সম্পাদকরা বা প্রকাশকরা কী-এক অজ্ঞাত কারণে আমার লেখা ছাপতে আগ্রহী। আমার লেখা সহজ বা জনপ্রিয় নয়।
তারপরেও হঠাৎ হঠাৎ এমন সব পাঠকের দেখা পেয়েছি, যে, আমি বিস্মিত হয়েছি। প্রকৃতার্থে এঁরাই আমাকে সজীব রেখেছেন।
আমি অনেক পেয়েছি। আমি কিছুই পাইনি ॥
(ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায়: আবদুল মান্নান সৈয়দ)