পুনরুত্থান।। আহমেদ মনসুর।। পুবাকাশ

গল্পটা তখনই শেষ হয়ে যেতে পারত, ইকবাল যখন ঘোষণা দিয়েছিল সে আর লেখালেখি করবে না। গোটা পাঁচেক বছর সে গুটিয়েও রেখেছিল নিজেকে। যাদের জন্য সে লিখে তারা ওর চিন্তার সমকক্ষ নয়। কেউ কেউ ছিল নিমগ্ন পাঠক। এই মনে হল ধরতে পেরেছে, মুহূর্তেই আবার লাইনচ্যুত হয়। মনে মনে ভুলভাল একটা মূল্যায়ন দাঁড় করিয়ে ক্ষান্ত হওয়া ছাড়া তাদের আসলে গত্যন্তর ছিল না।

কি লাভ হবে লিখে? ইকবালের মুখে আক্ষেপের সুর। প্রশ্নটা শুনে হো হো করে হেসে উঠেন কাজী সিরাজ। পঞ্চাশ বছর ধরে লিখছেন তিনি। প্রতিষ্ঠাবিরোধী লেখক। পুরস্কারে আস্থা নেই। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লেখালেখিকে মনে করেন নিছক গুন্ডামী। অনেকটা রবি ঠাকুরের ওই গানটার মতনই তাঁর পথ চলা- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চলো রে।

-শোন ইকবাল, তোমার ভিতরে একটা আগ্নেয়গিরির আগুন দেখতে পাচ্ছি, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ তুমি, হালে লিখতে আসা কারও মধ্যে এমনটা দেখি না সচরাচর। তোমার চিন্তার স্তর যাদের জন্য লিখছ তাদের থেকে অন্তত ত্রিশ বছর এগিয়ে। আজ থেকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে ওদের চিন্তার স্তর হয়তো তোমার সমপর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তখন তোমার লেখার কদর ওরা বুঝবে। নগদে মূল্যায়নের প্রত্যাশা ওসব লেখকরাই করবে যাদের মানস অগ্রগামী নয়, আমজনতার কাতারেও নয়, আরও নিচে। তুমি থেমো না, তোমার কাজ তুমি করে যাও।

-মূল্যায়নের নিকুচি করি সিরাজ ভাই। ভুল বুঝে নানা কথা শোনাতে যে ছাড়ছে না।

-তা ছাড়বে না। সমসাময়িক কালে মধুসূদন, নজরুলকেও ছাড়েনি। নজরুল তো আবেগপ্রবণ কবি ছিলেন। দুঃখ করে তাই লিখেছিলেন- ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব বুঝবে সেদিন বুঝবে’ নামের দীর্ঘ কবিতাটি।

এ বলেই কাজী সিরাজ পড়তে শুরু করেন নজরুলের সেই দীর্ঘ কবিতাটি।

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মর” কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্‌ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,-
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদ্‌নাতে চোখ বুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুজবে।

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ-
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী!
আসবে শিশির-রাত্রি!
থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,
থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
বঁধুর বুকের পরশনে
আমার পরশ আনবে মনে-
বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না ক আ সে-
তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,
আসবে না ক’ আর সে!
প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে
মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,
মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!
সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায়
কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ-
সখার কারা-বন্ধ!
বন্ধু তোমার হান্‌বে হেলা
ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
বইতে প্রাণের শান- এ ভার
মরণ-সনে বুঝ্‌বে-
বুঝবে সেদিন বুঝ্‌বে!

ফুট্‌বে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্‌নী-
চৈতী-রাতের চাঁদ্‌নী।
ঋতুর পরে ফির্‌বে ঋতু,
সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!
চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
যে-তারা তা’য় খুঁজবে-
বুঝ্‌বে সেদিন বুঝ্‌বে!

আস্‌বে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-
টুটবে যবে বন্ধন!
পড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
আপনি গালে যাচবে চুমা,
চাইবে আদর, মাগ্‌বে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুমবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।

আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হান্‌ত,
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান–
আসবে তখন পান’।
হয়ত তখন আমার কোলে
সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,
আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
চাপ্‌বে বুকে বাহু বেঁধে,
চরণ চুমে পূজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!’

কাজী সিরাজের কাতর গলার কবিতা পাঠ আর ইস্পাত-দৃঢ় কণ্ঠের অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য শুনে ইকবালের মনোযাতনার কিছুটা প্রশমিত হলো। সে আবার লিখতে শুরু করে। ঘোষণার কথা বেমালুম ভুলে যায়। শেষ হতে যাওয়া গল্পটি হঠাৎ নতুন বাঁক নেয়।

ইকবাল একটা সিগারেটের ডগায় আগুন দিয়ে নিজের দিকে কৃতজ্ঞতা আর তৃপ্তির দৃষ্টিতে তাকায়। কারণ ‘পুনরুত্থান’ নামের গল্পটা লিখে শেষ করল এইমাত্র। গল্পটা পাঠকের টেবিলে পরিবেশনের লোভ সামলাতে পারছি না। তবে ইকবালের নিষেধ কি করে উপেক্ষা করি!

সারমর্মটুকু শুধু বলি- ‘গ্রাম্যমেয়ে রাবেয়া যখন স্কুলে যেত, সকলে ওর দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসত। তাতেই যে ক্ষান্ত হতো তা নয়। কানাকানি ফিসফাস। হাতিঘোড়া গেল তল/ পিঁপড়ে বলে কত জল। লেখাপড়া করে জজ ব্যারিস্টার হইব। আরও কত কি।

রাবেয়ার বাবার কাছে এসেও ওরা শুনিয়ে যেত নানা কথা। মেয়ে হয়ে ঘরের বাইরে যায়। বেহায়াপনার তীর নিক্ষেপ করতেও ছাড়ে না। রাবেয়ার বাপ এ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে ওর পড়াশোনা বন্ধ করতে চেয়েছে অনেকবার। ও তাতে দমে যাওয়ার পাত্রী ছিল না। অদম্য গতিতে এগিয়ে গেছে শুধু।

রাবেয়া এখন পুলিশের এসপি। গ্রামের অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকদের নানাখানে সুপারিশ করে চাকরির বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এলাকার মসজিদটি দোতলা করে দিয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। স্কুল করে দিয়েছে দুইটা। দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে গ্রামের সব মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

পুরো গ্রামে রাবেয়া এখন একটা মডেলের নাম। মা-বাবারা সন্তানদের বলে- মন দিয়ে পড়ালেহা কর, বড় হয়ে রাবেয়ার মতন হতে হইবো।’

ইকবাল নেই এগার বছর। মারা গেছে ‘পুনরুত্থান’ লেখার ঊনিশবছর পর। কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য সরকার তার নামে এবার মরণোত্তর একুশে পদক ঘোষণা করেছে।

আহমেদ মনসুর : গল্পকার।

মন্তব্য করুন

এখানে মন্তব্য লিখুন
এখানে আপনার নাম লিখুন