ছফার স্মৃতি : স্ববিরোধ, বিদ্যা ও বেদনা।। জগলুল আসাদ।। পুবাকাশ
নামাজ পড়েন কিনা পুছ করলে তিনি উত্তর দিলেন, প্রাণ খুব চাইলে পড়ি । পন্ডিতি ক’রে তাকে একটু খোঁচানোর নিয়তে আমি জিগাইতে চাইলাম, তাহলে তো আপনি আপনার হৃদয়েরই ইবাদত করলেন, খোদার ইবাদত কই হইল। কিন্তু সাহস হলো না।
আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর নয়। বিশেষত,নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সন-তারিখ মনে থাকেনা প্রায়শই। যখন কিছু পড়তে বা লিখতে ইচ্ছে হয়না, তখন স্মৃতি হাতড়ে ফিরি। স্মৃতির সঞ্চয় লিখতে ইচ্ছে হয়।
তো, একবার আমরা ক’জন (সম্ভবত, সায়েম ভাই, সোহেল হাসান গালিব ভাই, মাদল ভাই, আর খালিদ ভাই) গিয়েছিলাম শাহবাগে, আহমদ ছফার ‘উত্থানপর্ব’ অফিসে। তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগের কথা। মিনিট বিশেক ছিলাম সম্ভবত। বেশিও হতে পারে। ওই তাকে প্রথম দেখা আমার। ইতোমধ্যেই আমাদের পড়া হয়ে গিয়েছিলো তার “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”,”যদ্যপি আমার গুরু”, “বাঙালী মুসলমানের মন”,”শতবর্ষের ফেরারি” আর তার একটি সাক্ষাতকার গ্রন্থ। কি কথা প্রসঙ্গে ছফা যেনো কয়েকবার ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করলেন। তো,আমাদের একজন বললেন,’আল্লাহ’ শব্দটিও তো আপনে ব্যবহার করতে পারেন। তিনি বললেন, ঈশ্বর সেকুলার শব্দ! মনে মনে ভাবলাম, ‘ঈশ্বর’এরও তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া ছাড়া গতি নাই! ছফা তার অনুভব দিয়ে সেকুলারিজমের সীমাবদ্ধতা কিন্তু ঠিকই বুঝতেন ; তবুও, চিন্তক হিশেবে যিনি জীবন্ত, ও সক্রিয়, স্ববিরোধিতা বা উল্লম্ফন তার থাকেই। শক্তিমান চিন্তক তার ভুল-শুদ্ধ সবটা নিয়েই প্রভাবশালী থাকেন সমকালে ও পরকালে। ছফা বা ফরহাদ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা সত্য মনে হয়। আমার ধারণা,ছফার ব্যাপক পড়াশুনা ছিলো না । তবে কাড়ি কাড়ি বই পড়ে অনেকের যা অর্জন হয়,ছফা তার সহজাত অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই তার অনেকটা অনুভব ক’রে ফেলতেন। যাই হোক,ওই সময় কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল তার কক্ষে এসে কি একটা চুক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ছফা ঠোটের এক কোণে মৃদু হাসি ফুটয়ে বললেন,দুনিয়ার কোন চুক্তি সম্পর্কেই আমি জানিনা। এই উত্তর শুইনা দেখলাম সাইফুল্লাহ মাহমুদ খুব কাঁচুমাচু বোধ করছেন । ছফার এমন নিরুত্তাপ ও অকপট উত্তর,আর নিজের কৃত্রিম অজ্ঞতাকে কিছু অচেনা তরুণের সামনে এভাবে উপস্থাপন আমাদের যুগপৎ বিষ্মিত ও মুগ্ধ করেছিল।
বাঙালি মুসলমান নিয়ে তার ভাবনা আমাদের জানা ছিলো । আমাদের ওই তারুণ্যের কালেও টের পেতাম তাঁর মুসলিম ভাবনার সীমাবদ্ধতা ! কি একটা জিজ্ঞেস করতে তিনি বলে উঠলেন, এই সম্প্রদায়কে আমি own করি। নামাজ পড়েন কিনা পুছ করলে তিনি উত্তর দিলেন, প্রাণ খুব চাইলে পড়ি । পন্ডিতি ক’রে তাকে একটু খোঁচানোর নিয়তে আমি জিগাইতে চাইলাম, তাহলে তো আপনি আপনার হৃদয়েরই ইবাদত করলেন, খোদার ইবাদত কই হইল। কিন্তু সাহস হলো না। মাঝে মাঝে মনে হয় , সেই হৃদয়েও আছে আশেকের ছিটেফোঁটা , যে-হৃদয় মাঝে মাঝেই নত হতে চায়, লুটিয়ে পরতে চায় সেজদায় ; সে-ও তো আবিদ ও মোমিন যার ভেতরে পরমের প্রগাঢ় অনুভব জাগে চকিতে । জাগে, মাঝে মাঝে হলেও । কে কোন উসিলায় ক্ষমা পায়, কে-বা জানে !
তার কাজ থাকায় আমাদেরকে উঠতে হলো, প্রথম ও শেষ বারের মত।
জাগলুল আসাদ: প্রাবন্ধিক-অনুবাদক। সম্পাদক- চিন্তাযান।